নির্বাচন নিয়ে বিএনপির হ্যাঁ বিএনপির না
সম্প্রতি বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা নয়াপল্টন কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলছিলেন। সেখানে দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য অকপটেই বলেন, নির্বাচনের সময়ে যদি নিরপেক্ষ সরকার হয়, যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে বেগম জিয়াকে জেলে রেখেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। কারণ, নির্বাচনের পক্ষে বেগম জিয়াও। তিনি জেলেই থাকুন আর বাইরেই থাকুন, সরকার দাবি-দাওয়া মেনে নিলে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। অবশ্য যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের এক নেতা প্রতিবাদের সুরেই বলেন, বেগম জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। আমাদের এই অবস্থানেই থাকতে হবে। প্রয়োজনে খালেদা জিয়ার মুক্তির একদফা দাবিতে রাজপথে নামতে হবে। কর্মী-সমর্থকদের বড় একটি অংশই এই বক্তব্য সমর্থন দেন। এ নিয়ে দুই পক্ষেই প্রায় ঘণ্টাব্যাপী যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিচ্ছিলেন।
কার্যত, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই এখন দুই ভাগে বিভক্ত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বড় একটি অংশই যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তবে তারা শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবির পক্ষে। সরকারকে শেষ মুহূর্ত চাপে রেখে যে কোনো পরিস্থিতিতেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। আবার স্থায়ী কমিটির ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং মধ্যসারি থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বড় অংশই খালেদাবিহীন নির্বাচনের বিপক্ষে। প্রয়োজনে একাদশ নির্বাচনও বর্জন করার পক্ষে। তবুও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে নারাজ এ অংশটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি এ মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। তবে সবার আগে গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট হতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। অন্যায়ভাবে দায়ের করা বিএনপির সব নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।’ সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকালে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি নেতারা জানান, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই তাকে কারাগারে রেখেছে সরকার। খালেদা জিয়াবিহীন কোনো নির্বাচনে তারা যাবেন না। বিষয়টি নিয়ে যেন তারা সরকারকে চাপ দেয় সে ব্যাপারেও বিএনপি অনুরোধ জানায়। কূটনীতিকরাও বিএনপিকে আশ্বস্ত করে বলেছে, এ বিষয়ে তারা সরকারকে বলবে। সম্প্রতি বিএনপির তৃণমূল নেতাদের বৈঠকেও বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। সেখানে মাঠপর্যায়ের নেতারা স্পষ্টই বলেন, বেগম জিয়া ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। এ জন্য তারা শক্ত কর্মসূচিও চান কেন্দ্রের কাছে। কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতারাও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রস্তুতি নিতে অনুরোধ জানান। জানা যায়, দলের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখেই বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা যে কোনো পরিস্থিতিতেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তারা মনে করছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না যাওয়া ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। ওই সময় সব প্রশাসনই ছিল দুদুল্যমান অবস্থায়। এতে বিএনপি জোটের জয়লাভেরই সম্ভাবনা ছিল বেশি। কোনো কারণে জয় না হলেও ৮০-১০০ আসন পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। অন্যদিকে দলের মধ্যসারি থেকে শুরু করে তৃণমূলের বড় একটি অংশই বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেই তারা মনে করছেন। এই নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে গেলে সরকার তার কৌশল বদল করত। বিএনপিকে ষড়যন্ত্রের মধ্যে ফেলে জাতীয় পার্টির চেয়েও কম আসন দিত। জানা যায়, প্রকাশ্যে খালেদার মুক্তি আন্দোলনের কথা বলা হলেও দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠপর্যায়ে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিগত রমজান মাসের ইফতার পার্টি থেকে শুরু করে নানাবিধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকেই ঢাকা ও লন্ডন থেকে সবুজ সংকেত নিয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছেন। বিশেষ করে সাবেক ছাত্রনেতাদের বড় একটি অংশই নিজ নিজ সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রত্যাশা, দল নির্বাচনে গেলে তারাই ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী। তাই আগেভাগেই নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি একদিনের নোটিসেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারে। এটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু সরকার আমাদের দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাইরে রেখে নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে। এটা সফল হবে না।’
সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘আমরা এখন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির বাইরে কিছু ভাবছি না। প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে চেয়ারপারসনকে মুক্ত করেই তার নেতৃত্বে নির্বাচনে যেতে চাই।’