ইউরোপে ঢোকার আগে ‘মৃত্যুফাঁদ’
- লিবিয়ার কারাগারে বন্দী ২৮০ বাংলাদেশি
- লিবিয়া হয়ে ইউরোপে ঢুকতে চেয়েছিলেন তাঁরা
- ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ
- যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের কারও লিবিয়ার ভিসা ছিল না
দালালের মাধ্যমে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করা বাংলাদেশের ২৮০ নাগরিক এখন আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। তাঁরা চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশে সুদান, মিসর, আলজেরিয়া, দুবাই ও জর্ডান থেকে লিবিয়ায় জড়ো হয়েছিলেন। পরে সেখানে ধরা পড়েন। ৬ আগস্ট লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।
অথচ ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। যাঁরা লিবিয়ায় গিয়ে ধরা পড়েছেন, তাঁদের কারও পাসপোর্টেই ওই দেশটির ভিসা ছিল না।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ইউরোপে যেতে আগ্রহী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দালালেরা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার চুক্তি করে। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ওই ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে পুরো টাকা আদায় করে দেশে থাকা দালালেরা। এরপর ওই ব্যক্তিকে লিবিয়ায় আটকে রেখে মুক্তিপণ বাবদ আরও কয়েক লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টা চলে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ইউরোপে লোক পাঠাতে মানব পাচারকারীরা এখন লিবিয়াকে নিরাপদ রুট (পথ) হিসেবে ব্যবহার করছেন। দালালের মাধ্যমে যাওয়া বেশির ভাগ বাংলাদেশির চেষ্টা থাকে লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের দেশ ইতালি ও গ্রিসে ঢোকা। এ ছাড়া লিবিয়া হয়ে স্পেনে যাওয়ারও চেষ্টা করেন অনেকে।
লিবিয়ার কারাগারে বন্দী বাংলাদেশিদের একজনের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারঠাকুরী ইউনিয়নে। নাম আশরাফুল আম্বিয়া। তাঁর ভাই আখলাকুল আম্বিয়া গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আশরাফুলকে স্পেনে পাঠানোর জন্য দালালদের সঙ্গে আট লাখ টাকার চুক্তি করেন তাঁরা। মে মাসে তাঁর ভাই দেশ ছাড়েন। এর এক মাস পর আশরাফুল লিবিয়া থেকে ফোন করে তাঁদের জানান, দালালেরা আরও তিন লাখ টাকা চায়। না দিলে তাঁকে মেরে ফেলবে। পরে চড়া সুদে টাকা ধার করে আরও দুই লাখ টাকা দেন দালালদের। সর্বশেষ গত ১ জুলাই দালালদের একজন জানায়, আশরাফুল কারাগারে। তাঁকে মুক্ত করতে আরও আড়াই লাখ টাকা দাবি করেছে দালালেরা।
জকিগঞ্জ উপজেলার ৪৬ যুবক এখন লিবিয়ার কারাগারে রয়েছেন বলে জানান আখলাকুল আম্বিয়া। তিনি বলেন, উপজেলার কাজলশাহ ইউনিয়নের শাহিন আহমেদসহ কয়েকজন দালাল অনেক দিন ধরে ইউরোপে লোক পাঠানোর নামে এভাবে প্রতারণা করে আসছে।
এ বিষয়ে শাহিন আহমেদের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে দুই দিন ধরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। তবে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। জকিগঞ্জের ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, শাহিনকে এখন আর এলাকায় দেখা যায় না।
দালালদের প্রতারণার শিকার জকিগঞ্জ উপজেলার আফতাব উদ্দিন। তিনিও লিবিয়ায় বন্দী। তাঁর ভাই আবদুছ ছামাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইসহ সিলেটের যেসব যুবক এখন লিবিয়ায় বন্দী, তাঁদের মুক্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তাঁরা।
সিলেট ছাড়াও মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক যুবক ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন হয় নিখোঁজ, নয়তো লিবিয়ার কারাগারে বন্দী রয়েছেন বলে জনশক্তি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। ওই যুবকদের মধ্যে মাদারীপুরের মুজিবুর রহমান ফরাজির ছেলেও রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে নাজমুল হাসান কয়েক মাস আগে দালালদের মাধ্যমে তুরস্কে যাওয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এরপর আর ছেলের খবর পাচ্ছেন না। বিভিন্নজনের কাছে জানতে পেরেছেন, তাঁর ছেলেও লিবিয়ার কারাগারে রয়েছেন।
লিবিয়ার কারাগার থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লিবিয়ার কারাগারে যারা আটক আছে, তাদের নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠিয়েছি। আর যারা প্রতারণা করছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুসন্ধান
লিবিয়া উপকূল থেকে ডিঙিতে করে ইউরোপে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি নিখোঁজ ও আটক হওয়ার কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ওই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস অনুসন্ধান চালায়। এতে দেখা যায়, গত ১৭ জুন ও ২৩ জুন দুটি নৌকায় থাকা ১৪৬ যাত্রীকে আটক করে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। পরে তাঁদের দেশটির অভিবাসন সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া ১৯ জুন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের একটি নৌকা সাগরে দুর্ঘটনায় পড়লে কিছু যাত্রী নিখোঁজ হন। লিবিয়ার উপকূল থেকে প্রতিবছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত (সাগর অনেকটা শান্ত থাকে) ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়।
দূতাবাস সূত্র জানায়, দালালেরা ইউরোপে মানব পাচারের জন্য ঢাকা-আবুধাবি-শারজাহ-আলেকজান্দ্রিয়া-বেনগাজি (লিবিয়া)—এই আকাশপথ বেশি ব্যবহার করে। এরপর সড়কপথে বেনগাজি-ত্রিপলি-জোয়ারা এলাকায় যায়। সেখান থেকে জোয়ারা উপকূল দিয়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের লিবিয়া কিংবা তুরস্ক রুট ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগরের রুট ব্যবহার করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়া নিরাপদ মনে করেন অনিয়মিত অভিবাসীরা।
ইউরোপের দেশগুলোয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি এক লাখ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোয় অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১৭ হাজার ২১৫ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তাঁদের মধ্যে ১১ হাজার ৭১৫ জনের আবেদন বাতিল হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) বাংলাদেশ থেকে ইতালির অনিয়মিত অভিবাসনপ্রক্রিয়ার ওপর সম্প্রতি এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তালিকায় ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে অবস্থান করে।
মানব পাচারে জড়িত দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ভেতরে যে প্রতারক চক্রটি এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না।’