স্বাভাবিক বাসস্থান ও খাদ্য সংকটে হরিয়ে যাচ্ছে দোয়েল সহ দেশী প্রজাতির পাখি
মাসুদ রানা (নওগাঁ ) প্রতিনিধি
পাখির প্রধান বাসস্থান হলো বন -জঙ্গল , গাছ-গাছালি তাই গাছ না থাকলে পাখি কিভাবে থাকবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভ’মি থাকা প্রয়েজন অথচ বাংলাদেশে মোট বনভ’মির পরিমান ১৭.৪ ভাগ । দেশের মোট আয়তন ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯৩ বর্গকিলোমিটার ।
এর মধ্যে বন ভ’মি রয়েছে ২৩ হাজার ৯৯৮ বর্গকিলোমিটার যা জনসংখার চাহিদার তুলনায় অনেক কম । তারপরও যেটুকু আছে তাও মানুষ র্নিচিারে কেটে ফেলছে ফলে পরিবেশ বির্পযয়, জলবায়ুর পরির্বতন , বদলে যাচেছ ঋতু চক্র , র্বষাকালে বৃষ্টি নেই ,বসন্ততেও শীত এতে মানুষের পাশাপাশি হুমকির মুখে পাখিক’লও ।
এক সময় সবুজ শ্যামল শষ্য সুফলা ছায়াঘেরা পতœীতলা সহ নওগাঁ বরেনদ্র অঞ্চলে ছিল জাতীয় পাখি দোয়েলের ঘন উপস্থিতি। বুক ফুলিয়ে গানের সুরে ডেকে বেড়াতো এরা। ক্রমশ নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জঙ্গল, গাছপালা ও ঘাসজমি কেটে ফেলায় স্বাভাবিক বাসস্থান সংকটে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে দোয়েল পাখি দোয়েল সহ দেশীয় পাখির সংখ্যা। ভয়ার্ত দোয়েল এখন আর আগের মত বুক ফুলিয়ে ডাকে না।
আগে এই অঞ্চলে বাড়িতেই ছিল খাম ও সিলিং। কিন্তু এখনকার বাড়িগুলোতে সেগুলো না থাকায় বাসা হারাচ্ছে অনেক প্রজাতির পাখি। পরিবেশ দূষণের ফলে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার ফলেও মারা যাচ্ছে অনেক পাখি। তা ছাড়া জলাশয়ের অভাবেও পাখির সংখ্যা কমছে।
এখন আর এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে মানুষ পৌঁছতে পারে না। তাই বাসস্থান হারাচ্ছে দোয়েলের মত পাখি। পোকা-মাকড়ের সংখ্যাও কমে গেছে। পাখিদের খাবারের অভাবও দেখা যাচ্ছে। দোয়েল পাখির বাচ্চারা বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকামাকড় খেত। পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের জীবনধারণও সঙ্কটে।
একাধিক পরিবেশবিদ বলেন, শুধুই বরেনদ্র অঞ্চল নই, সারা দেশেই কমে যাচ্ছে দোয়েল। দোয়েল কমে যাওয়ায় শুধুই যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে তা নয়, এর ফলে সমস্যায় পড়বে মানুষও।
সাদা ও কালোর সংমিশ্রণে গায়ের রং। বরেন্দ্র অনঞ্চলের সর্বত্রই এক সময় দোয়েল দেখা যেত। তবে এখনও কমবেশি চোখে পড়ে দোয়েল। সাধারণত বন, চাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে ও জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়।
দোয়েল আকারে ১৫-২০ সে:মি: বা ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা।পুরুষ দোয়েলের শরীরের উপরিভাগ ও গলার নিচে কালো রঙের, পেট সাদা। ডানার দুই পাশে সাদা রঙের প্যাঁচ আছে। স্ত্রী দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচে ছাই-রঙা হয়। পেটের অংশ পুরুষ দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়, বরং কিছুটা ফিকে সাদা। দোয়েলের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুলাই। ডিম দেয়ার এক সপ্তাহ আগে এরা গাছের কোটরে বা ছাদের কার্ণিশে বাসা বানায়। সাধারণত ৪/৫টি ডিম দেয়। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজ, তার উপর বাদামী ছোপ থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয় ; ৮ থেকে ১৪ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রত্যুষে যে পাখির একটানা সুরে ঘুম ভাঙ্গে পাখিটি হচ্ছে দোয়েল। যে পাখির সাথে আমাদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য স্মৃতি জড়িত রয়েছে।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয এই হাজার বছরের পরিচিত পাখি দোয়েল আজ বিলুপ্তির পথে। ইকোসিষ্টেমের পরিবর্তন, ক্রমান্নয়ে মানুষের আবাসস্থল সৃষ্টি, চোরাচালান অবৈধ শিকার, কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগ, বিদেশী আগ্রাসন, ফলসে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মৃত কীটপতঙ্গ খেয়ে মারা যায় অসংখ্য পাখি আর প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
এক সময়ে পতœীতলার গ্রাম-গঞ্জের মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, গাছে গাছে জাতীয় পাখি দোয়েলসহ নানা ধরনের পাখি দেখা গেলেও কালের আবর্তে এখন আর চিরচেনা সেই পাখি দেখা যায়না, পাখিদের কলরবে মুখর গ্রামের মেঠো পথ এখন পাখি শূন্য হতে চলছে।
বনে জঙ্গলে গাছে পাখি দেখার সেই অপরুপ দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। দুরভীন ব্যবহার করেও দুস্কর হয়ে পড়েছে পাখির দেখা।
পতœীতলা নাদৌড় গ্রমের ষাটার্ধো উম্মত আলী বলেন, কয়েক বছর আগেও মানুষের ঘুম ভাঙ্গত পাখির ডাকে। তখন বোঝা যেতো ভোর হয়েছে। পাখির কলকাকরীই বলে দিতো এখন সকাল, শুরু হক দৈনেন্দিন কর্মব্যস্থতা। কিন্তু এখন যেন সেই পাখির ডাক হারিয়ে গেছে, এখন আর গাছ গাছালিতে পাখির ডাক নেই।
কয়েকজন বয়স্কদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দোয়েল, ময়না, কোকিল, শালিক, চড়ুই ,পেচাঁ ,ডাহুক, ঘুঘু, মাছরাঙ্গা , সহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির পাখি গ্রামাঞ্চলের বিলে-ঝিলে, ঝোপে-ঝাড়ে, গাছের ডালে, বাগানে কিংবা বাড়ির আঙ্গিনার ডালে বসে তার সুরের ধ্বনিতে মুগ্ধ করে। এই পাখির কিচির মিছির শীষ দেওয়া শব্দ এখন আর কানে শোনা যায় না। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় বাঁশ গাছে, আমের ডালে, সজিনা গাছে, বাড়ির ছাদে যে পাখি সব সময় দেখা যেত সেই পাখি এখন আর চোঁখে পড়ে না।
তবে কম সংখ্যক টিয়া, ঘুঘু, বক, কাক, মাছরাঙ্গা, ইত্যাদি পাখি শহর, গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেলেও জাতীয় পাখি দোয়েল তেমন আর মানুষের চোখে পড়েনা। তাই পাখি প্রিয় অনেক সৌখিন মানুষকে বাড়ির খাচায় বন্ধি করে পাখি পালন করতে দেখা যায়।
নওগাঁ আলিদেওনা পাখি কলোনীর সভাপতি ,বঙ্গবন্ধু এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত ,পাখি প্রেমী র্নিমল র্বমন বলেন, দোয়েলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম ওই পাখি দেখতে পান না, তা ছাড়া শিকারীরের দৌরাত্মের কারনে পাখি শূন্য হয়ে পড়ছে বনাঞ্চল। তাই আমদেও সকলের উচিৎ এসব দেশীয় প্রজাতির পাখি সংরক্ষনে এগিয়ে আসা নয়তো অদুর ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম পাখি সম্পর্কে জানতে পারে।
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন ফেডারেশন ( বিবিসিএফ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনরি এন্ড এনিমেল সায়েন্স বিভাগের প্রফেসর ড. মো: জালাল উদ্দিন সরদার বলেন , বনাঞ্চলে নির্বচারে পাখি শিকার হচ্ছে। বন উজার করে গাছ কাটার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এতে পাখির বিচরন কমে যাচ্ছে।
তাছাড়াও ফসলে মাত্রারিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পাখির বিচরন ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। স¦াভাবিক বাসস্থান ও খাদ্য সংকট আর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বিলুপ্তির পথে দোয়েলসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখি । সরকারি-বেসরকারিভাবে এসব পাখি সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ না করা হলে এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে এদেশের বন্যপ্রাণী ও ইতিহাস ঐতিহ্য স্মৃতিবিজড়িত দোয়েলের মত গুরুত্বপূর্ণ পাখি।