র্যাব-১ এর অভিযানে গাজীপুরের রাজদিঘীর পাড় এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং এর দ্বন্দে নুরু হত্যার সাথে জড়িত মূল হোতাসহ ০৬ জন গ্রেফতার
বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং, গ্যাং কালচার, উঠতি বয়সি ছেলেদের মাঝে ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের মারামারি করা বহুল আলোচিত ও উদ্বেগজনক ঘটনায় পরিনত হয়েছে। এ ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে খুন হয়েছেন অনেক উঠতি বয়সের কিশোর। এমনি একটি ঘটনায় শিকার গাজীপুর সদর থানার ১৬ বছর বয়সি ফকির আলমগীরের ছেলে নুরুল ইসলাম @ নুরু। গত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখ দিনের আলোয় সামান্য ‘তুই’ বলা’কে কেন্দ্র করে সমবয়সীদের হাতে প্রাণ দিতে হয় নুরুল ইসলাম @ নুরু'কে।
২। গত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ইং তারিখ আনুমানিক ১৪০০ ঘটিকায় গাজীপুর সদর থানাধীন রাজদীঘির পাড় এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শক্রুতার জের ধরে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নুরুল ইসলাম @ নুরু (১৬) নামক একজন কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। উক্ত হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে নিহতের পিতা মোঃ ফকির আলমগীর বাদী হয়ে গাজীপুর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করে। যার নম্বর-০৯ তারিখ ০৩/০৯/২০১৯ ইং, ধারা ৩০২/৩৪ দঃ বিঃ।
৩। নিহতের পরিবারের নিকট হতে জানা যায় যে, ভিকটিম নুরুল ইসলাম পিতা-মাতার ০৩ জন সন্তানের মধ্যে সবার বড় ও তার ছোট দুই বোন আছে। ভিকটিমের পিতা ফকির আলী পেশায় একজন পাখি বিক্রেতা ও মাতা গৃহিনী। ফকির আলীর একার উপার্জনে পাঁচ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাই পিতার বোঁঝা অনেকটা হালকা করতে ভিকটিম নুরুল ইসলাম পড়ালেখা বন্ধ করে ফেরি করে চা বিক্রি শুরু করে এবং সংসারে অর্থের যোগান দিতে থাকে। ঘটনার দিন আনুমানিক ১৪০০ ঘটিকার দিকে দুপুরে খাবারের পর ভিকটিম পাশ্ববর্তী রাজ দীঘির পাড়ে যায়। সেখানে পূর্বে থেকে ওৎ পেতে থাকা সাহাপাড়ার “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্য ভিকটিমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে গুরুতর জখম করে। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন ভিকটিমকে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করে। একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়ে ভিকটিমের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।
৪। উক্ত নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়। বর্ণিত হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে র্যাব-১ তাৎক্ষনিকভাবে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে দ্রুততার সাথে ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
৫। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ইং তারিখ রাত ২২.৩০ ঘটিকা হইতে ১২/০৯/২০১৯ ইং তারিখ রাত ০৩.১৫ ঘটিকা পর্যন্ত র্যাব-১, উত্তরা, ঢাকার একটি আভিযানিক দল গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে বর্ণিত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামী ১) মোঃ রাসেল মিয়া (১৮), পিতা- মোঃ বাদল মিয়া, মাতা- মোছাঃ নাসিমা খাতুন, সাং- সুরাটি, থানা- হোসেনপুর, জেলা- কিশোরগঞ্জ, বর্তমান ঠিকানা- বাসা নং-৩৬৫, ওয়ার্ড নং-২৬, থানা- গাজীপুর সদর, জিএমপি, গাজীপুর, ২) মোঃ সৌরভ (২১), পিতা- মোঃ মনু মিয়া, মাতা- মাজেদা বেগম, সাং- নতুন পটকা, থানা- শ্রীপুর, জিএমপি, গাজীপুর, বর্তমান ঠিকানা- বাসা নং-৭৩, ওয়ার্ড নং-২৬, সাহাপাড়া, থানা- গাজীপুর সদর, জিএমপি, গাজীপুর, ৩) মোঃ আশরাফুল ইসলাম (১৭), পিতা- মোঃ শামীম হোসেন, মাতা- মোছাঃ আঞ্জু বেগম, সাং- জুগনিদাই, পোষ্ট- শাহাজাতপুর, থানা- শাহাজাতপুর, জেলা- সিরাজগঞ্জ, বর্তমান ঠিকানা- ওয়ার্ড নং-২৭, লক্ষীপুরা, থানা- গাজীপুর সদর, জিএমপি, গাজীপুর, ৪) মোঃ জোবায়ের (১৭), পিতা- মোঃ মহসিন শিকদার, মাতা- জোবেদা খাতুন, সাং- বনগ্রাম, থানা- কালিগঞ্জ, জেলা- গাজীপুর,
৫) মোঃ আমির হামজা (১৯), পিতা- মোঃ খায়রুল শেখ, মাতা- মোছাঃ আমেনা বেগম, সাং- ডালবাড়ী, থানা- দেওয়ানগঞ্জ, জেলা- জামালপুর, বর্তমান ঠিকানা- সাং- আশুলিয়া (আতিয়ার মোল্লার বাড়ীর ভাড়াটিয়া), থানা- আশুলিয়া, ডিএমপি, ঢাকা এবং ৬) মোঃ সুজন পাটোয়ারি (১৭), পিতা- আব্দুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী, মাতা- নুর সাহারা বেগম, সাং- জামতলা, থানা- গাজীপুর সদর, জিএমপি, গাজীপুর’দেরকে গ্রেফতার করে। এসময় গ্রেফতারকৃত আসামীদের নিকট হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ০২ টি চাপাতি ও ০১ টি ছুরা উদ্ধার করা হয় এবং ০৫ টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৮,০২০/- টাকা জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামীরা বর্ণিত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
৬। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, বর্ণিত এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং বিদ্যমান। এসব গ্রুপের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ¡ লেগেই থাকত। সিনিয়র গ্রুপের সদস্যকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ড ঘটে বলে জানা যায়। ঘটনার দুই দিন পূর্বে ভিকটিম নুরুল ইসলামের ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের ৬/৭ জন সদস্য স্থানীয় বালুর মাঠ এলাকায় আড্ডা দেওয়ার সময় একই এলাকার রাসেল এর “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। জুনিয়র গ্রুপের কাছে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় রাসেলের “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপের সদস্যরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং উপযুক্ত সুযোগ খুঁজতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে ঘটনার দিন “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপের ১০/১২ জন মিলে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের উপর অকস্মাৎ চড়াও হয়। এসময় ভিকটিম নুরুল তাদের আক্রমন থেকে বাচাঁর জন্য পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপের সদস্যরা অন্যান্যদের ধরতে না পেরে ভিকটিম নুরুলকে পুকুর থেকে তুলে ধারালো চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
৭। ধৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, তাদের গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যই স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে ৯ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং বেশ কয়েকজন আছে যারা পড়ালেখা করে না। একই এলাকায় বসবাসের সূত্রে এসব কিশোর গ্যাং গঠিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র স্কুল পর্যায়ে ছোট দল করে ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও সময়ের সাথে তারা এলাকা ভিত্তিক গ্যাং এ পরিনত হয়। এরপর তারা ঐ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করে পাশাপাশি চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন বেআইনী কাজের সাথে জড়িত হয়। আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য তারা স্থানীয়ভাবে বিশেষ প্রভাব আছে এমন কিশোরদেরও দলে নেয় যাদের অধিকাংশই পড়াশোনার মাঝ পথে ঝরে পড়েছে। একই এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং থাকায় তারা একে অপরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। যার ফলে তারা ছোট খাট বিষয় নিয়ে অধিকাংশ সময় দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। এলাকার নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং বিপক্ষ গ্রুপকে ভীত সন্ত্রস্ত করতেই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তারা স্বীকার করে।
৮। ধৃত আসামী মোঃ রাসেল মিয়া’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। সে মূলত এই গ্যাং এর লিডার। হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। অন্যদের উপর কর্তৃত্ব খাটানোর জন্যই সে তার এলাকার নামে “ভাই-ব্রাদারস” গ্রুপ গঠন করে। ঘটনার দিনে তার নেতৃত্বেই রুপের অন্যান্যরা মিলে ধারালো চাপাতি নিয়ে ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের সদস্যদের উপর আক্রমন করে এবং ভিকটিম নুরুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
৯। ধৃত আসামী মোঃ সৌরভ’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে ২০১৭ সলে এসএসসি পাশ করে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। এরপর সে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেয়। সে এই কিশোর গ্যাং এর একজন সক্রিয় সদস্য। এই গ্রুপের অন্যান্যদের তুলনায় সে বড় হলেও সে ধৃত আসামী রাসেলের নির্দেশ মেনে চলত। এলাকায় নিজের একটি অবস্থান তৈরী করার জন্য সে এই গ্যাং এ যোগ দেয়।
১০। ধৃত আসামী আশরাফুল ইসলাম’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। পাশাপাশি সে একটি হোটেলে ওয়েটারের কাজ করে। শুরু থেকেই এই কিশোর গ্যাং এর সাথে সে সক্রিয় রয়েছে। ভিকটিম নুরুল ইসলামকে হত্যার সময় সে রাসেলের সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এবং তাকে সহযোগীতা করেছিল বলে ধৃত আসামী জানায়।
১১। ধৃত আসামী জোবায়ের’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে তেজগাঁওয়ে একটি স্কুলে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। সে এই এলাকায় বসবাস না করলেও তাদের গ্যাং এর একজন সক্রিয় সদস্য। আসামী রাসেল এর মাধ্যম সে এই গ্যাং এর সাথে যুক্ত হয়। সে নুরুল ইসলাম’কে হত্যার সময় ধারালো চাপাতি নিয়ে ভিকটিম ও তার বন্ধুদের ধাওয়া করেছিল ও হত্যাকান্ডে অন্যান্যদের সহযোগীতা করেছিল।
২
১২।ধৃত আসামী আমির হামজা @ বাবু’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করে। ধৃত আসামী জোবায়ের এর সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। জোবায়ের গ্যাং কালচারে যুক্ত হওয়ার পর তার মাধ্যমেই সে এই গ্যাং এর সাথে যুক্ত হয়। সে অবসরের পুরো সময় তাদের এই কিশোর গ্যাং এর সাথে কাটায়। সে এই গ্যাং এর হয়ে স্থানীয় অন্যান্য গ্যাং এর সাথে মারামারিসহ বিভিন্ন বেআইনি কাজে সবসময় সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে বলে জানায়। হত্যাকান্ডের পর থেকেই মূল হোতাদের লুকিয়ে থাকতে এবং নিজের হেফাজতে অন্যদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।
১৩। ধৃত আসামী সুজন পাটোয়ারি’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে স্থানীয় একটি স্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। গ্যাং কালচারের প্রতি পূর্বে থেকেই আগ্রহ থাকায় তার বন্ধুদের মাধ্যমে সে এই গ্যাং এর সাথে যুক্ত হয়। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা প্রায়শই অন্য গ্যাং এর সদস্যদের সাথে অতি সামান্য বিষয় নিয়ে দ্বন্দে লিপ্ত হয়। অন্য কোন গ্যাং এর সদস্যদের তাদের এলাকায় দেখা মাত্র তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমন করে। হত্যাকান্ডের সময় ধৃত আসামী সুজন চাপাতি হাতে ভিকটিমকে আক্রমন করেছিল বলে জানায়।
১৪। জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আরও বেশ কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে র্যাবের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে।
১৫। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।