করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শিল্পেও
চীনে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শিল্পেও। কারণ, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের কাঁচামাল থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যই আসে চীন থেকে।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্ক্রু ড্রাইভার থেকে শুরু করে বড় বড় প্রকল্পের যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি হয়। এরই মধ্যে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন এলসিও (ঋণপত্র) বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে এ অচলাবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশকে বড় মূল্য দিতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ২৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। রপ্তানিও হয় উল্লেখযোগ্যহারে। এছাড়া রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। এখন সেই আমদানি কমায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আর রপ্তানি বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। আবার আমদানির অভাবে স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখনই আমদানি-রপ্তানির জন্য বিকল্প রাষ্ট্র খুঁজতে হবে।
এর প্রভাব মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যেহেতু দেশের রপ্তানিজাত পণ্যের অধিকাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে তাই উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আমদানির অভাবে স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। তাই এখনই আমদানি-রপ্তানির জন্য বিকল্প রাষ্ট্র খুঁজতে হবে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানিকারকেরাও। বিশেষ করে যারা ওভেন পোশাক রপ্তানি করেন। কারণ, ওভেন পোশাকের ৬০-৬৫ শতাংশ কাপড় আমদানি হয়, যার একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে।
ফলে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি বাড়লে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
এ ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক পণ্যের কাঁচামাল আসে চীন থেকে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ হয়ে আছে আমদানি-রপ্তানি। যা একটি ধাক্কা। অনেক পণ্যের কাঁচামাল কিন্তু চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আনাও যাবে না।
তাই এভাবে অচালবস্থা চলতে থাকতে এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ অবস্থা কতদিন চলতে থাকবে তা আমরা জানি না। তবে বেশি দিন চলতে থাকলে এটি বড় বাংলাদেশের জন্য বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
বিসিসিসিআইয়ের তথ্য অনুসারে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর ২০২১ সাল নাগাদ এটি ১৮ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে। এই সম্ভাবনায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ভোগ্য পণ্যের দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। নিজেদের ব্যবহারের জন্য চীন যেসব পণ্য আমদানি করে, পুরো পৃথিবীতে সেগুলোর দাম কমে যাচ্ছে। চীন যেগুলো রপ্তানি করে, সেগুলোর দাম বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বাজারেও এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক শিল্পের কাঁচামাল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপকরণ চীন থেকে আসে।
এসব বন্ধ থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।’ কেবল শিল্পই নয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ পদ্মা রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ থমকে যাচ্ছে।
কারণ, প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার কাজ করা চীনা নাগরিকরা তাদের নববর্ষে ছুটিতে গিয়ে আটকে পড়েছেন। কেবল চীনা জনবলই নয়, এসব প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকেই।
প্রকল্প পরিচালকরা জানিয়েছেন, চীন থেকে যন্ত্র আমদানি ও চীনা নাগরিকরা ফিরতে না পারলে প্রকল্পের কাজ থমকে যাবে, প্রকল্প বাস্তবায়ন পেছাবে। আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে সঙ্গে ব্যয় বাড়বে।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশের দুই বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে হিসাব করেছে বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই)।
ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে যেহেতু চীন থেকে কাঁচামাল আনা যাচ্ছে সেহেতু বাণিজ্যের জন্য বিকল্প ভাবতে হবে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি যেন না থামে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।’