ঘুরে আসুন চর কুকরি মুকরি
ঘনবসতিপূর্ণ ও বসবাসের অনুপযোগী শহরের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাহলে একটু সময় করে কিছু দিনের জন্য নিজেকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান। নিজের চোখকে উপহার দিন খুব সুন্দর নিরিবিলি কোনো এক জায়গা। যেখানে আপনি দেখতে পাবেন প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য, নিঃশ্বাস নিতে পারবেন প্রাণ খুলে।
যারা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেকে বিলীন করে দিতে চান, পছন্দ করেন দ্বীপ, সবুজ শস্য, বিশাল নদীর পানির ঢেউ, পাহাড়, তারা ঘুরে আসুন বাংলার বুক চিড়ে মনোরম প্রকৃতির খোঁজে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলেই পেয়ে যাবেন ভোলার চরফ্যাশনের চর কুকরি মুকরি।
দৃষ্টির সীমানার পুরোটা ফোকাস জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। দৃষ্টিকে সম্মোহন করে হাতছানি দিতে থাকে টুকরো টুকরো নিবিড় বনভূমি। শিল্পী তপুর গানের মত বলতে হয়, “একপাশে বঙ্গোপসাগর তোমার, অন্যপাশে বনভূমি"। উত্তাল ঢেউ, বৈরী বাতাস আর জলোচ্ছ্বাসের গর্জন যখন আপনার কর্ণকুহর হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে উদ্বেল করবে আপনার ভাবনার জগতকে, ঠিক তখনই অন্য পাশের সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি আপনাকে দিবে নিবিড় ভালোলাগার এক চিরসবুজ প্রশান্তি। আর এই অন্য পাশের সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি হল চর কুকরি মুকরি।
চোখ ধাঁধানো সবুজের সমারোহ আর শান্ত নিশ্চুপ প্রকৃতির বুকে নিজেকে বিলীন করে দিতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বৃহৎ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এই দ্বীপে ৷
এখানে দেখতে পাবেন নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও সরীসৃপ প্রাণী। শিয়ালের দল, হরিণের পাল, আর বন্য মহিষের বিশাল বাহিনীগুলো নিজ চোখে দেখতে বিশেষ কোন ভাগ্য না নিয়ে গেলেও অনায়াসে চোখের আঙিনায় চলে আসবে এরা। নাম না জানা হাজার রকমের গাছের সাথে সারি সারি নারিকেল গাছ আর বিশাল বালুকাময় চরটি দেখে মনে হবে আপনার অবস্থান কোন এক সৈকত পাড়ে। শীতকালে দেখা মিলবে হাজার হাজার অতিথি পাখির ৷
ভ্রমণের প্রস্তুতি:
শীতকালে এই চরের আসল রূপ, সৌন্দর্য দেখা যায় এবং পুরো চর পায়ে হেঁটে বেড়ানো যায়। তাছাড়া ক্যাম্পিং করতে চাইলে অবশ্যই শীতকালে যেতে হবে; না হলে মূল চরে ক্যাম্প করা যাবে না। বর্ষার সময় এই চর প্রায়ই ডুবন্ত থাকে তাই বর্ষায় না যাওয়াই ভালো ৷
সবচেয়ে ভালো সময় জানুয়ারি–মার্চ মাস ৷দর্শনীয় স্থান:
সম্পূর্ণ চরটি ঘুরে দেখার মত সুন্দর। বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে পারেন, দেখা হয়ে যাবে অনেক হরিণ, মহিষ আর শিয়াল বা তাদের দলের সাথে। বনে হাঁটার সময় সাবধান থাকবেন বিভিন্ন বিষাক্ত পোকা মাকড় ও সাপ থেকে। সন্ধ্যার আগেই বন থেকে বেড়িয়ে আসুন। আগে থেকে রাস্তা মনে রাখা উচিত, নাহলে রাস্তা হারিয়ে ঘোরপাক খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এই চরের কাছাকাছি ঢাল চর, চর মানিক, সোনার চর, রুপার চর সহ বেশ কিছু চর আছে। চাইলে কুকরি মুকরি থেকে রিসার্ভ ট্রলার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন এসব চরে ৷
যাতায়াত ব্যবস্থা:
সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নদী পথে যাতায়াত করা। ঢাকার সদরঘাট থেকে কর্ণফুলী-৪, প্রিন্স অফ রাসেল-৪, নিউ সাব্বির ২ ও ৩ লঞ্চে ভোলার ঘোষের হাট নামবেন।
সেখান থেকে লেগুনা করে চলে যাবেন চর কচ্ছপিয়া ঘাট, সময় লাগবে মোটামুটি ৪০-৫০ মিনিট। ভাড়া নিবে ৪০-৫০।
চর কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে লোকাল ট্রলারে, তেতুলিয়া নদী পার হয়ে পৌঁছাবেন চর কুকরী মুকরী বাজারে।
প্রতিদিন সকাল ৯টা ও দুপুর ১২ টায় চর কুকরি মুকরির জন্য লোকাল ট্রলার ছেড়ে যায়, তাই লোকালে যেতে চাইলে সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এভাবে যাওয়াই সবচেয়ে উত্তম, এতে অল্প খরচে ও কম ঝামেলায় পৌঁছে যেতে পারবেন।
চাইলে রিসার্ভ ট্রলার নিতে পারেন ৬০০-৮০০ টাকা নিবে যা আপনার ভ্রমণ খরচ বাড়িয়ে দিবে। তারপর পায়ে হেটে ঘুরে বেড়াবেন পুরো চর ও তার আশপাশ।
এছাড়াও সদরঘাট থেকে এম ভি ফারহান-২ বা টিপু-৪ লঞ্চে ভোলার চরফ্যাশন নেমে ১০ টাকা অটো ভাড়ায় বাসস্ট্যান্ড গিয়ে সেখান থেকে যেতে পারবেন চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। বাসে গেলে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে যা অনেকটা সময়সাপেক্ষ, তাই একটা লেগুনা রিসার্ভ করে চর কচ্ছপিয়া ঘাটে চলে যেতে পারেন ৷
সব গুলো লঞ্চ ঢাকা থেকে বিকাল ৫-৬ টার মধ্যে ছেড়ে যায় এবং ঘোষের হাট থেকে ৩-৪ টার মধ্যে ছেড়ে আসে।
এম ভি ফারহান-২ লঞ্চ ০১৭৩২ ১৮৪১৩২
এম ভি টিপু-৪ ০১৭১২৫৬১২৩৪
নিউ সাব্বির-২ ০১৭৫৩৮৩৫৮৫৮
প্রিন্স অফ রাসেল ০১৭১২ ৫৬১৫২০
নিউ সাব্বির-৩ ০১৭৯৯০৮৯৪৫৩
থাকার ব্যবস্থা
চর কুকরি মুকরিতে কোন আবাসিক হোটেল বা রিসোর্টের ব্যবস্থা নেই। থাকার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে উঠতে হবে। সেখানের বর্তমান(২০১৫) চেয়ারম্যান জনাব হাসিম মহাজনের সাথে বা তার সেক্রেটারি জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। জেলা পরিষদের সামনে আছে বিশাল ফাঁকা মাঠ আর পুকুর। বাজারের পাশেই এই ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়া বাজারে যে দুইটি খাবারের হোটেল আছে তাদের বললেও কোন বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে ৷
তবে সবচেয়ে সহজ আর মজাদার থাকার ব্যবস্থা হলো চরে ক্যাম্প করে থাকা। এতে খরচ যেমন বাঁচবে, সাথে পাবেন প্রাকৃতিক এক অন্যরকম ভিন্ন পরিবেশ। এই চরের যেখানে খুশি ক্যাম্প করতে পারেন, সম্পূর্ণ নিরাপদ। ক্যাম্প করার জন্য এখানে আছে, বিশাল জায়গা। আপনি যেখানে ইচ্ছা ক্যাম্প করতে পারবেন। তবে বনের ভিতরে ক্যাম্প করা থেকে বিরত থাকবেন। বনের পাশে বিশাল বালুর চর যেখানে ইচ্ছে ক্যাম্প করতে পারেন।
মূল চরের আগে একটি খাল আছে তা পার হয়ে ৩০০-৪০০ মিটার সামনের কিছু জায়গা আছে বনের পাশে গাছের ছায়ায় সেখানে ক্যাম্প করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই স্থানীয় কারো কাছে জোয়ারের পানি কতদূর পর্যন্ত আসে তা জেনে নিবেন। এখন পর্যন্ত যারা ব্যাকপ্যাকিং করেছেন আমার জানামতে সবাই এখানেই ক্যাম্প করেছিলেন। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের মাঠেও ক্যাম্প করতে পারেন ৷
চেয়ারম্যান সাহেবের সেক্রেটারি মোঃ জাকির: ০১৭৯৯৬৬৯৪১
খাবারের ব্যবস্থা
কুকরি মুকরি বাজারে দুটি খাবার হোটেল আছে, একটি নিমাই হোটেল যা সুমন ভাইয়ের অন্যটি মিজান ভাইয়ের। অর্ডার দিলে আপনার মন মত মেনু রেডি করে দিবে। ব্যাকপ্যাকিং করেও নিজেরা রান্না করে খেতে পারবেন ৷ এই চরে লাকড়ির অভাব নেই ৷
যেখানে ক্যাম্প করবেন তার আশেপাশে ১০-২০ মিটার হাঁটলেই তিন চারদিনের লাকড়ি যোগাড় হয়ে যাবে। যদি ব্যাক-প্যাকিংয়ে নিজেরা রান্না করে খেতে না চাইলে হোটেলে বলে দিতে পারেন, রান্না করে আপনার কাছে পৌঁছে দিবে। তাছাড়া স্থানীয় অনেক লোক আছে যারা ব্যাকপ্যাকারদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে থাকে ৷
আর বাজার থেকে ড্রাম ভাড়া নিয়ে মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করতে পারবেন। নদীর পানি লবণাক্ত তাই পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। শুধু পান করা ছাড়া ভুলেও মিষ্টি পানি খরচ করবেন না, কারণ প্রায় ৩ কি.মি. হেঁটে আপনাকে এই পানি সংগ্রহ করতে হবে, না হয় জোয়ার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যা অনেক সময় সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য ৷
খাবারের হোটেল সুমন: ০১৭১৪৯৩৩৯৮১
খাবারের হোটেল মিজান: ০১৭৩৭৫০৯৬৭
পরামর্শ ও সতর্কতা
✔ যেহেতু চর এলাকা তাই গাড়ির কোন ব্যবস্থা নাই, যাদের হাঁটার অভ্যাস নাই বা অনিহা তারা না যাওয়াই ভালো।
✔ বনের ভিতরে ক্যাম্প করা থেকে বিরত থাকুন।
✔ বনের বেশি গহীনে যাবেন না, আর গেলেও অন্তত দু জন নিয়ে যাবেন যেন পথ হারিয়ে না ফেলেন।
✔ যেহেতু বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, তাই তাদের চলার পথে বাধার সৃষ্টি করবেন না বা প্রাণীকে ভয় দেখাবেন না।
✔ শিয়ালের উৎপাত বেশ ভালোই এই চরে তাই রাতে তাবু থেকে নিরাপদ দূরত্বে ক্যাম্প ফায়ার করবেন অবশ্যই।
✔ হরিণ শিকার থেকে বিরত থাকবেন, ইহা দণ্ডনীয় অপরাধ।
✔ সরীসৃপ প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে অতিরিক্ত সতর্কতা
স্বরূপ ক্যাম্প গ্রাউন্ডের চারিপাশে কার্বলিক এসিড ছিটিয়ে দিন।
✔ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেয়ে বন নোংড়া থেকে বিরত থাকবেন। এমন ভাবে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিন যেন কোন চিহ্ন না থাকে।
✔ খাবার দাবারের ঝুটা নদীতে বা বালুতে গর্ত করে পুতে দিন। আর সকল প্রকার পলি প্যাকেট ব্যাগে ভরে নিয়ে আসুন, চর নোংরা করবেন না।
✔ প্রকৃতির ওপড় কোন খারাপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।
✔ হৈ হল্লুর, চিল্লাচিল্লি থেকে বিরত থাকুন। খালি পায়ে বনের ভিতর হাঁটবেন না।
✔ যে জায়গায় ক্যাম্প করবেন ফিরে আসার আগে সে জায়গা এমন ভাবেই রেখে আসুন যেভাবে ক্যাম্প করার আগে পেয়েছিলেন, যেন কেউ না বুঝতে পারে এখানে কেউ বা কারা এসে দুই এক রাত থেকে ছিলো।
✔ এই অঞ্চলে বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা নেই, তাই অবশ্যই পাওয়ার ব্যাংক সাথে রাখুন। আর বাজারে সোলার পাবেন সেখানেও মোবাইল চার্জ করতে পারেন যা অনেক সময়সাপেক্ষ।
✔ স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন, তাদের অমায়িক ব্যবহারে আপনি নিজেও মুগ্ধ হবেন।
✔ যে কোন সমস্যায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করুন, খুবই ভালো আর অমায়িক একজন মানুষ। বিশেষ করে টুরিস্টদের জন্য বেশ হেল্পফুল একজন মানুষ।
✔ নদীতে গোসলে সতর্কতা অবলম্বন করুন, সাতার না জানলে বেশী দূর যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
✔ গ্রামীনফোন ও রবির নেটওয়ার্ক পাবেন এই চরে তাই এরকম অপারেটর এর সিম সচল রাখুন ৷