গোলাপীর রঙ্গিন স্বপ্ন আর পূরণ হলো না
বি এ রায়হান, গজীপুর:
স্বপ্ন পূরণ হল না কুড়িগ্রামের চিলমারী থানার বালাবাড়িহাট এলাকার গোলাপী আক্তারের (৩০)। ২০১০ সালে একই এলাকার আইনুল ইসলামের সাথে বিয়ে হয় গোলাপীর। ২০১১ সালে একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে সন্তান হয় গোলাপীর। নাম দেওয়া হয় মেয়ে আখি মনি (৯) এর পর সংসারের অভাব-অনটন দূর করার জন্য স্বামী সন্তান কে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এসে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে একটি শিল্প কারখানায় কাজ করেন গোলাপী।
২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়ে হলে গোলাপীর নতুন স্বপ্ন দেখতে থাকেন। দ্বিতীয় মেয়ের নাম ইশা মনি। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়ের বয়স আট। কালিয়াকৈর স্থানীয় একটি গ্রাম বাংলা নামের বে-সরকারি স্কুলের ২য় শ্রেণীতে পড়ে সে। গোলাপীর স্বপ্ন ছিল মেয়েটিকে পড়াশোনা করিয়ে বড় হলে নার্স বানিয়ে নিজের ও গ্রামের বাড়ির মানুষদের বিনামূল্যে সেবা দিবে।
গত দুই বছর যাবৎ গাজীপুর কালিয়াকৈরের উলুসাড়া এলাকায় এফবি ফুটওয়ার জুতা তৈরির কারখানায় হেল্পার হিসেবে ৭ হাজার ৮শ টাকায় যোগদান করেন। স্বামী একটি ঝুটের গোডাউনে কাজ করতো। বেতন সহ পুরো টাকা স্বামী আইনুল ইসলামের নিকট জমা রাখতো সে। প্রতিবন্ধী মেয়ে, ছোট মেয়ের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ দিয়ে প্রতি মাসে তাদের মাসে ৫ হাজার টাকা জমা রাখতো গোলাপী। এ টাকা দিয়ে ছোট মেয়ে ইশা মনি কে নার্সিংয়ে পড়ালেখা করাবে। ছোট মেয়ের স্বপ্ন নিয়েই দিন-রাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছিল গোলাপী।
শনিবার (১০ অক্টোবর ২০২০ইং) বিকেল
সাড়ে ৪টায় হঠাৎ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সব স্বপ্ন ধ্বংশ করে দেয় গোলাপীর। হয়তো আর স্বপ্ন পূরণ হবে না গোলাপীর এমন কথা জানাচ্ছিল তার স্বামী আইনুল ইসলাম। তিনি আরো জানায়, শনিবার আগুনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি ছোট মেয়েকে নিয়ে রাত ৮টার দিকে কারখানার সামনে গিয়ে ফোন করি। একাধিক ফোন করেও বন্ধ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার সন্দহে হয়, আমার গোলাপী মনে হয় আর নাই। অতিতে কোনদিন একবারের বেশি দু‘বার ফোন দিতে হয়নি
গোলাপীকে। ফোনটা ধরেই ছোট মেয়ের কথা বলতো সে। এত ফোন কোনদিনই দেওয়া হয়নি তাকে। আমি কারখানার ভিতরে ঢুকার অনেক
চেষ্ঠা করেছি। কর্তৃপক্ষ আমাকে ঢুকতে দেয়নি। রাত ৯টার দিকে আমার মন বলে দিয়েছে আমার গোলাপী আর নেই। অনেক কান্নাকাটি করেছি
কেউ আমার কান্নাকাটির দাম দেয়নি। আমার প্রতিবন্ধী মেয়ে সহ দুই মেয়ে নিয়ে কারখানার গেইটেই সারা রাত দাড়িয়ে ছিলাম। সকাল ১০টা
পর্যন্ত আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ ফায়ার সার্ভিসের একটি টীম আমার গোলাপীর পুরা নিথুর দেহ নিয়ে এসে বলে গোলাপী আক্তার নামে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। হঠাৎ গোলাপীকে দেখে চিনতে পারিনি আমি। পরে, তার শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখে চিনতে পারলাম সেই আমার গোলাপী। অনেক ডাক-চিৎকার দিয়েছি গোলাপী আমার কথা শুনে না। বড় মেয়ে কিছুই বুঝে না। ছোট মেয়ে মা হারিয়ে চুপ হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে শুধু কান্নাকাটি করছে। কোন কিছুতেই বুঝাতে পারছি না। আমি
এখন কি করবো। কোথায় যাবো দু‘মেয়েকে নিয়ে। গোলাপীর অনেক স্বপ্ন ছিল ছোট মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে বড় হলে নার্স হিসেবে গ্রামের মানুষদের বিনামূল্যে সেবা দিবে। আজ মনে হয় গোলাপীর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।
নিহত গোলাপীর বড় মামা রফিক জানায়, ছোট বেলা থেকেই গোলাপীর অনেক স্বপ্ন ছিল গ্রামের মানুষদের সেবা করবে। সংসারের অভাবের
কারনে আমি তাকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিয়ে আসি। আজ সব স্বপ্ন ধ্বংশ হল গোলাপীর। সকলে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে তার লাশ বুঝিয়ে দিলে গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম, চিলমারি থানা, রানিগঞ্জ সরদার পাড়া এলাকায় দাফন করা হবে। দুপুরে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে, কারখানা কর্তৃপক্ষ থেকে তেমন কোন কিছু পাইনি।
এদিকে, শনিবার বিকেলে সাড়ে ৪টার দিকে কারখানার ভিতরে বিকট শব্দে একটি বৈদ্যুতিক মটর বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের সুত্র হয়। মুহুর্তের
মধ্যেই আগুন পুড়ে কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। পুড়ে যায় কারখানার বিভিন্ন প্রকার মুল্যবান মেশিনপত্র, কেমিক্যাল ও জুতা তৈরির সরঞ্জাম। আগুন নিয়ন্ত্রণে কালিয়াকৈর, সাভার ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট কাজ করে প্রায় ৬ঘন্টা পর নিয়ন্ত্রণে আনেন। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডাম্পিং এর কাজ চলে।
এষিয়ে কালিয়াকৈর ফায়ার সার্ভিসের ষ্টেশন কর্মকর্তা কবির আলম জানায়, যেহেতু এটি একটি জুতার কারখানা। এখানে কেমিক্যাল থাকতে পারে। যেজন্য ডাম্পিং এর জন্য সময় দিতে হয়। আরো সময় লাগতে পারে। তবে, এখন পর্যন্ত কারখানার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
গোলাপী আক্তার নামের একজনের মৃত দেহ উদ্ধার ও ৫ শ্রমিক আহত হয়।