আপনাকেই দিতে হবে নির্দেশনাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গত ২৭ জানুয়ারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে টিকা দিয়ে বাংলাদেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় সারা দেশে গণটিকাদান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত শনিবার পর্যন্ত সারা দেশে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে প্রায় ২১ লাখ মানুষকে।
অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও বেশি মানুষ এরই মধ্যে টিকা নিয়েছে। টিকা নিতে নিবন্ধন করেছে প্রায় ২ শতাংশ মানুষ। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই প্রায় আড়াই লাখ মানুষ টিকা নিচ্ছে। এখন সরকার প্রথম দফায় ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেবে বলে ঠিক করেছে।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বেরিয়ে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ সংক্রমণ পর্যায়ে রয়েছে। এটা আরো দুই সপ্তাহ থাকলে তখন সেটাকে বলা যাবে বিচ্ছিন্ন সংক্রমণের পর্যায়। তারপর যদি শনাক্ত শূন্য হয় তখন দেশ করোনামুক্ত হলেও অন্য দেশে যেহেতু থাকবে, সেহেতু বাংলাদেশও মহামারির মধ্যেই থেকে যাবে।
আর মহামারি থাকলেই যেকোনো সময় আবার সংক্রমণের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এমনকি এখনো আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। অনেক দেশেই এখন এমনটা দেখা যাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। এরই মধ্যে একটি নতুন আশঙ্কার খবর এসেছে আমাদের গণমাধ্যমে। প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ঢুকে গেছে করোনার যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকান নতুন ভেরিয়েন্ট বা নতুন বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট করোনাভাইরাস।
সর্বশেষ গত মাসেও যুক্তরাজ্যের ওই ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ দেশে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ আছে নতুন ভেরিয়েন্ট মনিটরিংসহ অন্যান্য সংক্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরা জিআইএসএআইডির ওয়েবসাইটে। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, আমাদের সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, নিবন্ধন ও টিকা দেওয়া নিয়ে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এত দিন অনেকে নিবন্ধন করার পর টিকা দেওয়ার নির্ধারিত দিন জানানোর আগেই নিবন্ধন কার্ড নিয়ে নিজ নিজ কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেকে আবার যে কেন্দ্রে নিবন্ধন করেছেন, সেই কেন্দ্রে না গিয়ে অন্য কেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিয়েছেন। কিংবা নিবন্ধন না করে পছন্দসই কোনো কেন্দ্রে গিয়ে স্পট নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন। এখন আর স্পট নিবন্ধনের সুযোগ নেই। নির্ধারিত কেন্দ্র এবং নির্ধারিত তারিখ ছাড়া কেউ টিকাও নিতে পারবেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পর্যন্ত যাঁরা টিকা নিতে পেরেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এর নিচের পর্যায়ের মানুষ এখনো টিকার নাগাল পাননি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে গ্রামের মানুষরাও রয়ে গেছেন টিকার বাইরে। গণমাধ্যম আরো বলছে, সরকারি পর্যায় থেকে বারবার পরিকল্পনা পাল্টানোতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। টিকা দেওয়া শুরু করার আগে যদি সুচিন্তিত পরিকল্পনা করা হতো, তাহলে বিভ্রান্তি কমে মানুষের ভোগান্তি কমত বলে বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত।
উদাহরণ হিসেবে আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবর তুলে ধরতে পারি। এসব খবরে বলা হয়েছে, কোথাও কোথাও মানুষ নিবন্ধন করতে পারছে না। এমনকি অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা অনেকের পক্ষেও নিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার নিবন্ধনের সময় নিজের সুবিধামতো বা পছন্দের কেন্দ্র পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, যেসব কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার চাহিদা বা পছন্দ বেশি, সেগুলোতে তারিখ পেতে অপেক্ষায় বা সিরিয়ালে থাকতে হচ্ছে বেশি। শুধু তারিখ না পাওয়াই নয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোনো কোনো উপজেলায় চাহিদা বেশি থাকলেও টিকা গেছে কম। সব মিলিয়ে বিষয়টিকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
খুব সংগত কারণেই করোনাভাইরাসের টিকার নিবন্ধন আরো সহজ করতে তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। সহজে নিবন্ধন করতে সরকারের হাতে আরো বেশ কিছু বিকল্প পথ থাকলেও তা কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, টিকা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের বয়স একই হওয়ায় কেন্দ্রে গিয়ে কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া এড়িয়ে সরকারের উদ্যোগেই গণনিবন্ধন করা যায়।
কেউ কেউ অবশ্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বুথ বসিয়ে বিনা মূল্যে নিবন্ধন করার পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কারো কারো মতে, বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মীদেরও নিবন্ধন কাজে লাগানো যেতে পারে।
কল্যাণমুখী সরকার দেশের মানুষের জন্য করোনার টিকার ব্যবস্থা করেছে। এখন এই টিকা দেওয়ার বিষয়টি সবার জন্য সহজ করা দরকার। টিকা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ভালো। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপক সফলতা রয়েছে। পোলিও নির্মূল এবং ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস ‘বি’ ও রুবেলার মতো মারণব্যাধি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করেছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।
১৭ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি অনেক বেশি গতি পেয়েছে। অথচ ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। প্রথমে আমাদের দেশের মানুষের একটু আপত্তি ছিল। তিনি নিজে মানুষের কাছে গিয়ে ভ্যাকসিন খাওয়াতে শুরু করেন। ফলে সারা দেশে মানুষের মধ্যে এমন একটা চেতনা জাগ্রত হয় যে তারা নিজেরাই এখন টিকাদান কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
করোনার টিকার ব্যাপারেও আমরা সেই একই দৃশ্য যেন দেখতে পাচ্ছি। শুরুতে মানুষের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও এখন তা কেটে গেছে। সাধারণ মানুষেরও টিকার ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। এখন নিবন্ধনের পদ্ধতি সহজ করতে হবে। টিকা নিয়ে যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে, উপজেলায়, ইউনিয়নে, গ্রামে গ্রামে। সব কেন্দ্র সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলে নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রে ভিড় হবে না। মানুষ সহজে টিকা নিতে পারবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নির্দেশনাটি কিন্তু আপনাকেই দিতে হবে।