দেশজুড়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে উৎসবমুখর বর্ষবরণ
বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ পালিত হলো উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। রাত থেকেই বিভিন্ন সড়কে আল্পনা আঁকা, কনসার্ট, বর্ষকে সাড়ম্বরে বরণ করে নেয়ার প্রবল উদ্দীপনার রেশেই নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনের সূর্যোদয়, আর এর সাথেই সাথেই উৎসব আমেজ যেনো ছড়িয়ে যায় দেশ জুড়ে।
বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখি মেলা, র্যালি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে বাঙালি সংস্কৃতির চিরন্তন স্নিগ্ধতার প্রকাশ ছিলো লক্ষ্যণীয়। এদিনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাপ্তি ছিলো এবার আরও বড়। দেশের বিভিন্ন জায়গাতেও উৎসব আয়োজনে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
শুক্রবার নতুন বছরে প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোর ৬টা ১০ মিনিটে রাজরূপা চৌধুরীর সরোদ বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এরপর রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও’ গানটি।
শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন আর সাধারণ মানুষের মিলনমেলায় মুখরিত ছিলো ‘হাজারও কন্ঠে বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখের সূচনায় চ্যানেল আই-সুরের ধারা’র আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে এই আয়োজন। পুরো দেশ থেকে নির্বাচিত একহাজার শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় গান। সুরের ধারার পর্ব শেষ হয় সমবেত কন্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের মাধ্যমে। এরপর মঞ্চে গান গেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু ও তার দল এলআরবি, কোনালসহ আরও অনেকে।
তবে ‘সানসিল্ক নিবেদিত হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ’এর আয়োজনে যোগ দিতে এসে অনেকেই পড়েছেন বিড়ম্বনায়। ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্স থাকায় অনেক নারী দর্শক ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। ব্যাগ থাকায় বিপদে পড়েছেন গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকও। নিরাপত্তার কথা বলে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দেশজুড়েই এমন কঠোর নিরাপত্তার পরিবেশ বজায় ছিলো।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকেও নববর্ষ উদযাপনে ২৫টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেখানে সূর্যাস্তের পর অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধ্যবাধকতা দিয়ে বলা হয়, এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ইনডোর এবং সংরক্ষিত স্থানে তা করা যাবে।
নিরাপত্তা বিধানের এমন কড়াকড়ি সত্যেও বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনে মানুষের উপস্থিতি ছিলো ব্যাপক। ভোরে বাংলা একাডেমিতে গানে গানে স্বাগত জানানো হয় পয়লা বৈশাখকে। আয়োজনে ছিলো আবৃত্তি আলোচনা ও বৈশাখী মেলা।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। প্রতিবারের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রায় হরেক রঙের মুখোশ, হাতি, বাঘ, ফুল, পাখির প্রতিকৃতি ছিল। সমৃদ্ধির প্রতীক কালো হাতি সবার সামনে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় রাখা হয় সূর্য। সেটি পেছনে ঘোরালে দেখা যায়—একটি কালো মুখ। যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বাংলার ঐতিহ্যকে। সকাল নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। গত বছর ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন ছিলো আরও বড়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের নেতৃত্বে জাবির টিএসসি থেকে বিশাল বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়।
অন্যান্য বারের মত এবারো নতুন বছর বরণ করে নিতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নানা পরিবেশনায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।
রাজধানীর শাহবাগের ভাসানী সড়কে শিশু পার্কের সামনে নারকেল বীথি চত্বরে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠি আয়োজন করে বর্ষবরণ ও প্রভাতী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বারিধারা সোসাইটিতে সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার অনুষ্ঠান।
বিনামূল্যে রক্তদান কর্মসূচী করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাক্তার কামরুল হাসান খান।
জাতীয় প্রেসক্লাব নানা আয়োজনে বর্ষবরণ করেছে। ক্লাবের সদস্যদের সন্তানরা প্রেসক্লাব চত্বর মুখরিত করে রাখে। ছিল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিখ্যাত পুতুল নাচও।
ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে ললিত কলা একাডেমীসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে।
রাজধানীসহ সারাদেশের স্কুলগুলো ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় নববর্ষকে বরণ করে নেয়। বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বৈশাখ বরণে ছিল বাঙালি লোকজ সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিবেশনা। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বর্ষবরণের আয়োজনের মধ্যে ছিল লোকজ গান, দেশীয় নৃত্য, বৈশাখী মেলা, যেমন খুশি তেমন সাজো ইত্যাদি। বাঙালির লোকজ ঐতিহ্য তুলে ধরে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে কোন কোন স্কুল।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নানা বয়সী মানুষ সাড়ম্বরে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠে। পোশাক, খাওয়াদাওয়া, গানবাদ্য—সবকিছুতেই থাকে বাঙালিয়ানা।
বরাবরের মতো বাঙালির এই উৎসব আয়োজনে একাত্ম হয়েছিলো বিদেশীরাও ।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের মানুষ আনন্দলোকেই থাকবে। পুরানো জঞ্জাল পরিষ্কার করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।
‘শান্তি সুখের কলরবে, এসো মিলি মুক্তির উৎসবে’ স্লোগান নিয়ে জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস আয়োজিত বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এসময় তিনি দেশ ও মানু্ষের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান।
এবারের বাঙালির উৎসব আয়োজনে নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছিলো। উৎসব নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি ছিলো। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি যেনো উৎসবেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণারোপ করেছে, এমনটাই অভিমত অনেকের।