টার্গেট কেন ?আল-জাজিরা
কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধ তুলে নিতে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশ আগামী ১০ দিনের মধ্যে সম্প্রচার বন্ধের শর্ত দিয়েছে। সৌদি জোটের এই শর্তগুলোর মধ্যে আল-জাজিরা বন্ধের বিষয়টি তাদের অন্যতম প্রধান দাবি। কিন্তু ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ’ হিসেবে জারি করা নিষেধাজ্ঞায় একটি সংবাদমাধ্যম কেন টার্গেট?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই সংবাদমাধ্যম গত বিশ বছর ধরে যুদ্ধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কাভারেজের মাধ্যমে উপসাগরীয় অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করে এসেছে। এ কারণে সৌদির নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের অবরোধ আরোপের ঘটনায় কারণ হিসেবে কাতারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ এবং অর্থায়নের অভিযোগ করা হলেও প্রথম থেকেই ঘটনার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে এই আল-জাজিরা। মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার কাজে কাতার আল-জাজিরাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও দেশগুলো অভিযোগ করছে।
এনডিটিভি’তে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাজতন্ত্রের আরব বিশ্বে গণমাধ্যম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এর মাঝেও কাতারভিত্তিক নেটওয়ার্ক আল-জাজিরা সেই তুলনায় অনেক ভিন্নধর্মী সাংবাদিকতা করে এবং এমন অনেক বিষয়ও কাভার করে, যা অতি রক্ষণশীল আরব গণমাধ্যমগুলোতে নিষিদ্ধ। এছাড়া অন্যান্য আরব মিডিয়ার তুলনায় আল-জাজিরায় পাওয়া সংবাদ ও মতামতে জনমতের পরিসর অনেক বৈচিত্র্যময়।
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে আল-জাজিরা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এ কারণে আল-জাজিরা সৌদি আর মিশরের মতো কট্টর রক্ষণশীল শাসকদের শত্রু হয়ে গেছে। ওই শাসকরা চায় না রাজতন্ত্রের শাসিত জনগণ রাজতন্ত্রের সমালোচনা করা সংবাদ দেখুক।
আল-জাজিরার মতো একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম তার কন্টেন্ট এর মাধ্যমে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কাঠামো নাড়িয়ে দিতে পারে- এমনটা আঁচ করতে পেরে কাতারের অবরোধ ইস্যুতে এই সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করার শর্ত দিতে পারে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মফিজুর রহমান। তা না হলে এমন একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নম্বর এজেন্ডা হিসেবে থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, পুরো আরব অঞ্চল একটি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে রয়েছে। এ ধরণের শাসনব্যবস্থায় সবসময় তথ্য লুকিয়ে রাখার একটি প্রবণতা কাজ করে। একইসঙ্গে রাজতন্ত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আড়ালে রাখার চেষ্টা বেশি থাকে। কিন্তু নিজস্ব চরিত্রের কারণেই গণমাধ্যম এসব ভারসাম্যহীনতা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকে তুলে ধরে।
‘তাই একটি গণমাধ্যম যত শক্তিশালী হবে, রক্ষণশীল শাসকবর্গ, বিশেষ করে প্রথাগত রাজতন্ত্রের মতো শাসনব্যবস্থাগুলোর অবস্থা ততই নড়বড়ে হতে থাকে। ইতিহাসে এর প্রমাণ রয়েছে। তাই আল-জাজিরার মতো একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম আরব অঞ্চলে থেকে যেভাবে তার কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাতে রাজতন্ত্রগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। তারা ভাবতে পারে, হয়তো সামনের দিনে সংবাদমাধ্যমটির প্রচারিত খবরের কারণে দেশের জনগণের মাঝে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মনোভাব বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলার প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে। তখন তাদের ক্ষমতার কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে আল-জাজিরা বন্ধের ওপর এত জোর দেয়া হচ্ছে।’
সাংবাদিকতার এই শিক্ষকের মতে, অবরোধ তুলে নেয়ার ১৩ দফা দাবির মধ্যে কেন্দ্রীয় দাবি হিসেবে একটি গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকাটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, ফিলিস্তিন সঙ্কট বা ইয়েমেনের যুদ্ধের মতো মধ্যপ্রাচ্যের নানা সঙ্কট আল-জাজিরায় যেভাবে কাভারেজ পায়, তা স্বাভাবিকভাবে ওই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে বেশিরভাগ সময় সৌদি আরবের বিরুদ্ধেই যায়।
তাছাড়া যেসব অঞ্চলে সৌদির ‘পকেট পাওয়ার’গুলোর সঙ্গে কাতারের বৈরি সম্পর্ক রয়েছে আল-জাজিরার সংবাদে সেগুলো সম্পর্কেও নানা তথ্য প্রায়ই উঠে আসে। সুতরাং এত বছরের একটা ক্ষোভ এখানে কাজ করতে পারে। তবে সার্বিকভাবে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং সৌদি বিরোধী আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাভারেজ পাওয়া এখানে বড় একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
কাতার সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীদের ১৩টি শর্ত ‘অযৌক্তিক এবং বাস্তবায়নের অযোগ্য’ উল্লেখ করে মেনে নিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
দেশটির যোগাযোগ কার্যালয়ের পরিচালক শেখ সাইফ বিন আহমেদ আল থানি বলেন, ‘এই তালিকাই প্রমাণ করে কাতার আগে থেকে যা বলছিল সেটাই ঠিক – এই অবৈধ অবরোধে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কাতারের সার্বভৌমত্ব সীমিত করা এবং আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে বাইরের ক্ষমতার হাতে তুলে দেয়ার লক্ষ্যেই এই অবরোধ।’
অন্যদিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থা আল-জাজিরা বন্ধের এই দাবিকে সাংবাদিকতা এবং জনগণের তথ্য লাভের অধিকারের ওপর আঘাত হিসেবে মন্তব্য করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যও বলেছে, কাতারের কাছে করা দাবিগুলো অবশ্যই সুবিবেচিত এবং বাস্তবসম্মত হওয়া দরকার।