পদ্মা সেতুর মুল স্প্যান নদীর মাঝ দৃশ্যমান পাইলের উপরে উঠানো হচ্ছে
রুবেল মাদবর মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
মুন্সিগঞ্জ লৌহজং উপজেলার মাওয়ার পদ্মার পাড়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে মহাযজ্ঞ চলছে। আগামী একাদশ নির্বাচনের আগেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্যে এখানে জোর প্রচেষ্টা চলছে। সেই লক্ষে এখানে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা শিপট হিসেবে কাজচলছে। খুব শিঘ্রই পদ্মা সেতু জাতির কাছে দৃশমান হবে।সেই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারের কাজ হয়ে গেছে। আর পদ্মা সেতুর মূল স্প্যান পদ্মা নদীর মাঝে দৃশ্যমান পাইলের উপরে উঠানো হয়েছে। এরমধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। খুব শিঘ্রই উঠবে বাকি স্প্যান গুলো। সেতু কর্তৃপক্ষ শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন তা অনেকটা এগিয়েছে। এর আগে পিয়ারের ওপর ইস্পাতের মূল কাঠামো স্থাপন কিছুটা পিছিয়ে ছিল। কর্ম পরিকল্পনার কারণে এখন আর তা নেই।প্রকল্পের কাজের এই পর্যায়ে নদীর তলদেশের মাটির কিছু সমস্যার কারণে এমনটা হয়ে ছিল। প্রকল্পের নথি ও কর্মকর্তাদের সুত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ৬ মিটার উচ্চতার পিয়ার ক্যাপ ১১মিটার পিয়ারের উপরে বসানো হবে। অর্থাৎ৪র্থ তলা দালান সমান নদীর পানি লেভেল থেকে মোট ১৭মিটার উঁচুতে তার উপড় বসবে সেতুর ছাদ গাড়ি চলাচলের জন্য।সরজমিনে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে দুটি পিয়ারের মধ্যে একটি ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান) বসানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। নকশা অনুসারে ইস্পাতের এই কাঠামোর ভেতর দিয়েই হবে রেলপথ। আর ওপর দিয়ে থাকবে যানবাহন চলাচলের পথ। যে কাঠামে তৈরির কাজ চলছে জাজিরায়।এখন কাঠামো বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর মূলকাঠামো প্রথমে বসানো হবে দক্ষিণ প্রান্তে। ফলে জাজিরার দিক থেকে সেতুটি দৃশ্যমান হবে। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প উদ্যোগ নেওয়ার পর একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে সেতু বিভাগ। সেই পরিকল্পনায় চার বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে।সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা একাধিকবার মাওয়া প্রান্তে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। দুই পাড়ের ডাঙার অংশ ধরলে দৈর্ঘ্য হবে৯ কিলোমিটারের বেশি।তিন দফা সংশোধনের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। সাধারণত তিনবারের বেশি প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের সুযোগ নেই। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রয়োজন হলে আরও সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। গত সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল সেতু ৩৭ শতাংশ ও নদীশাসনের কাজ ৩০ শতাংশ এগিয়েছে। এর বাইরে দুইপারের সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা, সহায়ক অবকাঠামো, পুনর্বাসনের কাজ প্রায় শেষ। ৩ হাজার ২শ টন ওজনের স্প্যান টি ৪ হাজার টন ক্ষমতার ক্রেন দিয়ে পিয়ারের স্থানে বসানোর কাজ চলমান আছে ।সেতু বিভাগের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার নির্বাচনের আগেই সেতুটি চালু করতে চায়। সবাই সর্বাত্মক চেষ্টাও করছে। কিন্তু পদ্মা নদীর গঠন এবং এর আচরণ নানা অনিশ্চয়তায় ভরা। ফলে মূল সেতুও নদীশাসনের কাজ বেশ জটিল। প্রতি পদে পদে চ্যালেঞ্জ আসছে। এরপরও সময়মতো কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী তাঁরা।সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন প্রায় তিন হাজার লোক কাজ করছে। তবে কর্মীর সংখ্যা বাড়ে-কমে। শুকনো মৌসুমে বেশি লোক কাজ করে। আবার বর্ষায় কিছুটা কমে যায়। এখানকার কর্মরতদের মধ্যে আট শতাধিক বিদেশি, যাঁদের বেশির ভাগই চীনের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপানসহ আরও অনেক দেশের নাগরিক আছেন এখানে। তাঁদের বেশির ভাগ ব্যক্তি পরামর্শকদাতা। সেতু প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার উপড়ে খরচ হয়েছে। পদ্মা সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদী ও ডাঙা মিলিয়ে ১৭টি স্থানে বড় বড় ক্রেন ও অন্য যন্ত্র বসিয়ে কাজ চলছে। এই স্থানগুলোতে পিয়ার উঠবে।১ থেকে ৪২ পর্যন্ত নম্বর দিয়ে প্রতিটি পিলারের স্থান চিহ্নিত করা আছে।১৭টি পিয়ারের স্থানে কোথাও চলছে পাইল বসানোর কাজ। কোথাও পাইলের ওপরে ক্যাপ নির্মাণ হচ্ছে। এই ক্যাপের ওপরেই পিলার নির্মাণ করা হবে।সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, নদীতে থাকা ৪০টি পিয়ারের নিচের পাইল ইস্পাতের।আর ডাঙার দুটি পিলারের পাইল কংক্রিটের। নদী ও ডাঙা মিলে ছয়টি পিলার নির্মাণের স্থানে এখন পর্যন্ত পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ১১টি পিয়ারের স্থানে পাইল বসানোর কাজ চলমান আছে। আর তিনটি স্থানে পাইলের ওপর ক্যাপ বসানো হয়েছে, যার ওপর নির্মাণ করা হবে।কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এসব ভারী কাঠামো নির্মাণ মাঠ থেকে উঠিয়ে পিয়ারের ওপর বসানোর জন্য চার হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ক্রেন এসেছেগত বছরের অক্টোবরে। কাজ দেরি হওয়ার কারণে সাদা রঙের এই ক্রেন মাঝনদীতেঅলস বসিয়ে রাখা হয়েছিল বেস কিছু দিন ধরে।কাজ দেরি হয়েছে বলে এখন একটির বদলে একসঙ্গে পাঁচটি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত পিয়ারের ওপর এসব স্প্যান বসানো হবে। এর সবকটিই জাজিরায় অবস্থিত।দ্বিতল পদ্মা সেতুর নিচের অর্থাৎ ভেতরের অংশে রেললাইন বসাতে হবে। এর জন্য আলাদা প্রকল্প আছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। আর ইস্পাতের কাঠামোর ওপরের অংশে যান চলাচলের উপযোগী পথ তৈরি করতে দুই মিটার পুরো তিন হাজারকংক্রিটের স্প্যান বসানো হবে। এর ওপর দেওয়া হবে বিটুমিনের স্তর।সংশ্লিষ্টরা বলেন বিপুল ওজনের ইস্পাতের কাঠামো মাওয়া প্রান্তে রেখে দেওয়া হয়েছে। স্থাপন করার জন্য জাজিরায় ক্রেনে করে পরিবহনের সময় ঝড়ের কবলে পড়বে কি না, সেই শঙ্কা কাজ করছে কর্মকর্তাদের মধ্যে।এ জন্য জাপান থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার আধুনিক যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি ২৪ ঘণ্টা আগেই আবহাওয়ার অবস্থা জানাবে। মোট ২৪০টি পিয়ারের মধ্যে ১২৬টি পাইল নকশায় উল্লেখ করা গভীরতায় বসালেই চলবেবলে সিদ্ধান্ত হয়।পদ্মা সেতুর প্রকল্পের মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ তদারক করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের ওপরে রয়েছে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল। ১১ সদস্যের এই প্যানেলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কলম্বিয়ার সেতু বিশেষজ্ঞরারয়েছেন।বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর নকশায় উল্লেখ করা গভীরতার চেয়ে আট মিটার বাড়িয়ে ৬২টি পাইল ১২৮ মিটার পর্যন্ত বসানো হয়েছে। আর কোনো পাইলের গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন কি না, তা জানার জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।