ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে ‘শিীতল পাটি’
শাহ মো: জিয়াউর রহমান,নীলফামারী
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ছিট রাজিব গ্রামের দুন্দিপাড়া গ্রামের মতিয়ার রহমানের স্ত্রী মালেকা বেগম (৪৫)। তার মত শ’ শ’ নারী ছেড়ে দিয়েছেন “শিতল পাটি” বা শপ বানানো।
তারা বলেন,“আগোত শপের খুব চাহিদা ছিলো, এ্যালা কমি গেইছে, হামরাও আর আগের মতন বানাই না, খাটিখুটি লাভ ও হয়ছে না, পাড়াটাত সোবার বাড়িতে বাড়িতে শপ বানাইছিলো, এ্যালা ছাড়ি দিছে”।
স্থানীয় মমতাজ আলী (৫৫) আক্ষেপ করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শপ তৈরি করে আসছি, “এ্যাখন আর এইলা মানসি নেয়ছে না। হাটে বাজারে প্লাস্টিকের শপ ব্যারেয়া হাতে তৈরি শিতল পাটি হ্যারে যায় ছে। তারপর ও এলাকার কিছু পুরুষ-মহিলা অল্পকরে বানে (তৈরি) হাটোত ব্যাঁচে ধরি ধুইছে”।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে শিতল পাটির দুর্দিন দেখা গেছে পাড়া মহল্লায়। কিশোরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বাংলাবাজার, দুন্দিপাড়া, ছিট রাজিব, মুসাসহ কয়েক গ্রামের সহ¯্রাধিক পরিবার শপ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এখন প্লাস্টিকের পণ্যের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে শপ। বাসা-বাড়িতে হাতে তৈরি শপের বদলে জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিকের শপ।
স্থানীয়রা জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে শিতল পাটি বানিয়ে সংসার চালিয়ে আসছিলো এখানকার মানুষরা। কিন্তু বাজার হারিয়ে যাওয়ায় পেশা বদল করে কেউবা রিকসা-ভ্যান, কেউবা কাজের জন্য বিভিন্ন জেলায় গমন করেছেন। আর কেউ কোন রকমে ছোট দোকান করে টিকে আছেন ।
স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন আকারের শিতল পাটি ৪০-১০০টাকা পর্যন্ত পাইকারি দরে বিক্রি হয় বাংলাবাজার নামক হাটে। এই হাট থেকে এখানকার পাটি যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে বাজার খারাপ বলে জানালেন পাইকারি বিক্রেতা মুসা আলী।
তিনি বলেন, আগে খুব চাহিদা ছিলো। এখন শপ যাচ্ছে না বেশি। আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার নিয়েও শপ দিতে পারতাম না, হিমশিম খেতাম কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই।
কিশোরগঞ্জ ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড সদস্য ফিরোজ করিম মিঠু বলেন, আমরা দেখেছি এখানকার হাতে তৈরি শপের রমরমা ব্যবসা। এটার উপর নির্ভর করে জীবন জীবিকা ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা সহ সকল খরচ চালাতো এ আয়ের উপর। এখন কষ্টে পড়েছেন এই পেশার সাথে জড়িতরা।
স্থানীয়রা জানান, বারো মাস শপ বানানো হতো পাড়া মহল্লায়। পরিবারের সবাই কাজে জড়িত ছিলো। ছেলে-মেয়েরা স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে ফাঁকা সময়ে শপ বানানোর কাজে নিয়োজিত থাকতো। এখন আর কেউ এটা করতে চায় না।
আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের কেউ খবর রাখে না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। পুঁিজ হারিয়েছি। ব্যাংক বলেন, এনজিও বলেন, কেউ আমাদের ঋণও দেয় না। এ পেশার সাথে জড়িতদের দিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।
স্থানীয় উন্নয়ন কর্মী কবির হোসেন বলেন, ঐতিহ্য লালন করে হাতে তৈরি শিতল পাটি। এখন ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা সঠিক ভাবে বাজার ধরিয়ে দিতে পারছি না তাদের। এজন্য সরকারী ভাবে এগিয়ে আসা দরকার। প্রয়োজনে সহযোগীতা করে এখানকার শিতল পাটি বিদেশে ও রফতানী করা সম্ভব।
স্থানীয়রা আরও জানান, শিতল পাটি তৈরির মুল উপাদান(কাঁচামাল) মোতা তৈরিতে অনেক খরচ পড়ে। পরিশ্রমও বেশি কিন্তু বাজার দর ভালো না হওয়ায় দিন দিন একেবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তৈরি কারিগররা।
সরকারী ভাবে শিতল পাটি তৈরি কারকদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বাজার তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহেদি হাসান।
তিনি জানান, বিআরডিবি’র সহযোগীতায় উৎপাদিত শপ বিক্রির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে বেসরকারী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপন করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে যাতে করে ঐতিহ্যগত এই পণ্যটি ধরে রাখতে পারেন।