মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে মিয়ানমারের ‘খারাপ’ পরিণতিই হবে
রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর প্রস্তাবিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তা দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
গতকাল এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির মুখপাত্র।
সেনাবাহিনীর উপর অবরোধ আরোপ হলে মিয়ানমারের অপরিণত বেসামরিক সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে— এর শুধু ‘খারাপ’ পরিণতিই হবে।
ওয়াশিংটনের এ পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় অং সান সু চির মুখপাত্র জ হতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দরকার। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা এ দেশের জনগণের ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনিয়োগে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া আরও অনেক খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
দেশের অর্থনীতির উন্নতির জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দরকার। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ভ্রমণ ও ব্যবসা বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত মানুষদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে এছাড়া আরও অনেক খারাপ পরিণতি আছে বলে জানান তিনি।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে আইনপ্রণেতারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু নিষেধাজ্ঞা ও ভ্রমণ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাবসংবলিত একটি বিল উত্থাপন করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘ ও প্রথম এশিয়া সফর শুরুর আগের দিন কংগ্রেস এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এটিকে রোহিঙ্গা সংকটে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপের একটি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মার্কিন সিনেটের কয়েকজন সদস্যের উত্থাপিত এ বিল পাস হলে গতবছর মিয়ানমারের ওপর থেকে তুলে নেয়া কিছু নিষেধাজ্ঞা আবার ফিরিয়ে আনা হতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সেগুলো প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া বিল পাস হলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দেয়া মার্কিন সহায়তাও বন্ধ হয়ে যাবে যতক্ষণ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়নে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার না হবে।
সু চির মুখপাত্র আরও বলেন, মিয়ানমারে ১৫ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের আসার কথা। ওই সময় রাখাইন নিয়ে সরকারের প্রচেষ্টার কথা তার কাছে তুলে ধরা হবে। তবে এখনো মিয়ানমার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কী, সেটা তারা জানেন না।
মুখপাত্র বলেন, রাখাইন নিয়ে যে পদক্ষেপই মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকার গ্রহণ করুক তাতে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, এ দেশের পুনর্গঠন কাজ সু চি সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে তা খুব পরিষ্কার।
গত ২০০৮ সালের সংবিধানের অধীন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করেই সব করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা ও চাপ সরকারের কাজে ব্যাঘাত ঘটাবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তবে তা ইতিবাচক ফল আনবে না; যেটা অতীত অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে। নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিতভাবে সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন ব্যবসা-বিনিয়োগই শুধু নয়, সব বিনিয়োগই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এদিকে, মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব নিয়ে বিলটি উত্থাপনকারী আইনপ্রণেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন সিনেটের আর্মড সার্ভিস কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন ও সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট সদস্য বেন কার্ডিন।
কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও অনুরূপ একটি বিল আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সিনেটে বিল উত্থাপন-পরবর্তী আলোচনায় আইনপ্রণেতারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার জবাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ দেন।
গত ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এইচআরডব্লিউ: মিয়ানমারকে আইসিসিতে পাঠানো হোক
রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিষ্ঠুরতার তদন্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সম্মুখীন করার পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি গতকাল এ আহ্বান জানিয়ে আরও বলেছে, মিয়ানমারকে যাতে আইসিসি ও অন্যান্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর উচিত দেশটির ফৌজদারি অপরাধ-সংক্রান্ত প্রমাণাদি জোগাড়ের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া।
রাষ্ট্রহীন মানুষ নাগরিকত্বের অধিকার রাখে: ইউএনএইচসিআর
বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ কোটি মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে বলে গতকাল জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটি বলেছে, এসব শরণার্থীর মধ্যে ৩০ লাখ লোকের এই অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।
‘দিস ইজ আওয়ার হোম-স্টেটলেস মাইনরিটিজ অ্যান্ড দেয়ার সার্চ ফর সিটিজেনশিপ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউএনএইচসিআর বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে ২০২৪ সালের মধ্যে এসব মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে, বাসস জানিয়েছে, জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রর্ত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।’
শুক্রবার এখানে প্রাপ্ত এক বার্তায় বলা হয়, গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশে সৃষ্টি হওয়া সংকট সমাধানে তিনি রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেন।
শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতাকালে গ্র্যান্ডি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্থানচ্যুত ক্রমবর্ধমান এই জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠাতে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আন্তর্জাতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
গ্র্যান্ডি বলেন, রাষ্ট্রবিহীন করে রাখা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিতে অগ্রগতি প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক মীমাংসা এবং সকল সম্প্রদায়ের জন্য কল্যাণকর হয় এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিনিয়োগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্র্যান্ডি বলেন, এর পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত লোকদের সুরক্ষা বজায় রাখাও অতীব জরুরি।
আর তারা বৃহত্তর স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে কাজ করছে এমন ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ এবং বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে সহায়তা দেয়ার চেষ্টারত সম্প্রদায় উভয়ের মধ্য থেকে সংঘাত নিরসনের সমাধান খোঁজা হচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদে গ্র্যান্ডি বলেন, কার্যত সারা বিশ্বে বেশ কিছু নতুন সংকটের কারণে ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, সারা বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকের সংখ্যা বর্তমানে ছয় কোটি ৬ কোটি ৬০ লাখ ছুঁই ছুঁই করছে, যা ২০০৯ সালের চেয়ে চার কোটি ২০ লাখ বেশি।
ইউএনএইচসিআর প্রধান বলেন, সারা বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত কোটি কোটি লোকের সমস্যার সমাধান বের করা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে বিপুল সংখ্যক লোকের দেশান্তরী হবার ঘটনা ঘটেছে তা এড়ানোর বিষযটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।
গ্র্যান্ডি সিরিয়ার বির্পযয়কর সংঘাত, ইরাকের সহিংসতাসহ বেশ কিছু চলমান সংকটের কথা উদ্ধৃত
করেন, যা সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুতির ঘটনার এক চতুর্থাংশের জন্য দায়ী।