গোপালগঞ্জের চান্দার বিল জীব বৈচিত্র্যে ভরা এক বিশাল জলাভূমি
মো:হাচিবুর রহমান ,গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : ১০ হাজার ৮৯০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত চান্দার বিল জীব বৈচিত্রে ভরা এক বিশাল জলাভূমি। এর পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধূমতি বিলরুট ক্যানেল। গোপালগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী চান্দার বিল আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে উচু বন ভূমি ছিল বলে জানা যায়। এখানে তখন জনবসতি ছিল না ছিল বন্য পশুর অবাধ বিচরন ক্ষেত্র। ভূমিকম্পের ফলে ওই সব বনভূমি দেবে গিয়ে বিশাল জলাভূমিতে পরিনত হয়। বিগত ৩শ’ বছর আগে চান্দার বিল এলাকা ঘিরে জনবসতি গড়ে উঠে।
গোপালগঞ্জ জেলার সদর, মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৩৪টি মৌজা নিয়ে আজকের যে চান্দার বিল তার মধ্যে ৫৪ হাজার লোকের বসবাস । এখানকার শতকারা ৮০ ভাগ হিন্দু, ১৫ ভাগ মুসলমান এবং ভাগ খ্রীষ্টান সম্প্রদায় ভূক্ত। শতকরা ৭০ ভাগ লোক কৃষিকে প্রধান পেশা হিসাবে নিয়েছেন। যাদের অনেকেই বছরের বেশীর ভাগ সময় কৃষি কাজ এবং বাকী সময় মৎস্য শিকার করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। খন্ডকালীন মৎস্য শিকার ছাড়াও অনেক জেলে সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে কেবল মাছ ধরাই যাদের পেশা। এখানে এক সময় এত বিপুল পরিমান প্রাকৃতিক মাছ ছিল যে চান্দার বিল বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাছের অভয়ারন্য হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। মাছের প্রাচুর্যের জন্য এ বিলকে এখনও বলা হয় গোপালগঞ্জের ঐতিহ্য। সাড়ে ৫ হাজার মাছের কুয়া চান্দার বিলে সারা বছরই মাছ ধরা হয়। বর্ষাকালে পেশাদার জেলেদের পাশাপাশি কৃষকেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ন মাসে সবচেয়ে বেশী মাছ ধরা হয়। এ সময় প্রতি মাসে গড়ে ৮০ টন মাছ ধরা হয় বলে স্থানীয় সূএে জানা যায়।
চান্দার বিলে সাড়ে ৫ হাজার কুয়া রয়েছে। বর্ষা চলে যাওয়ার সময় এ সব কুয়ায় মাছের জন্য আকর্ষনীয় বিভিন্ন গাছের ডাল কেটে ফেলে রাখা হয়। এই কুয়া থেকেই শুস্ক মৌসুমে পাওয়ার পাম্প দিয়ে পানি সেচের মাধ্যমে মাছ ধরা হয়। এ ভাবে মাছ ধরার ফলে ক্ষুদে পোনা এবং মাছের ডিম পর্যন্ত বিনাশ হয়ে যায়। প্রতি মাসে ২ হাজার টন শামুক নিধন হয় এই চান্দার বিলে। মাছের পাশপাশি রয়েছে বিপুল পরিমান শামুক। বিগত ৭/৮ বছর যাবত এ শামুক ব্যাপক ভাবে নিধন করা হচ্ছে। এখানকার শামুক চিংড়ির খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫০টি ট্রলার ও শতাধিক ডিঙ্গি নৌকা শামুক ধরায় ব্যস্ত থাকে। অসংখ্য দরিদ্র নারী-পুরুষ শামুক ধরাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে যেখানে চিংড়ি চাষ হচ্ছে সেখানে এগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।
এলাকায় কর্মরত বেসরকারি পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা বিসিএএস এর এক জরিপের তথ্যে জানা যায়, প্রতি মাসে চান্দার বিল থেকে গড়ে ২ হাজার টন শামুক ধরা হয়। এ ভাবে শামুক নিধন অব্যাহত থাকলে চান্দার বিল থেকে এক সময় শামুক বিলীন হয়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। যা পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। প্রায় ১৫০০ জন লোক কুচিয়া ধরে। চান্দার বিলের আরেক জলজ প্রানীর মধ্যে কুচিয়া অন্যতম। কুচিয়া দেখতে সর্পাকৃতি এক ধরনের মাছ বিশেষ। এ বিলে কি পরিমান কুচিয়া আছে তা নিরুপন করা সম্ভব নয়। কার্তিক মাস থেকে জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কুচিয়া ধরার উপযুক্ত সময়। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও শেরপুর এলাকার খ্রীষ্টান উপজাতি এবং রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন চান্দার বিলে কুচিয়া ধরতে আসে। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে জানা গেছে, প্রায় দেড় হাজার লোক কুচিয়া ধরতে এই এলাকায় আসে। প্রতিদিন একজন শিকারী ৫ কেজি থেকে ১০কেজি পর্যন্ত কুচিয়া ধরে বলে জানা যায়। প্রতি কেজি কুচিয়া স্থানীয় টেকেরহাট বাজারে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়। শিকারীরা জানায়, এ সব কুচিয়া ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয়। কুচিয়া ওই সব দেশের এক শ্রেনীর মানুষের প্রিয় খাদ্য। আমাদের দেশেরও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কুচিয়া মাছ খায়।
চান্দার বিলের খনিজ সম্পদ পিট কয়লা চান্দার বিলের আরেক সম্পদ হলো পিট কয়লা। চান্দার বিলের নদীর তীরে মাঠ-ঘাঠ কিংবা বিল অঞ্চলের ৩/৪ হাত মাটি খুড়লে বেরিয়ে আসে পিট কয়লা। কোদালের সাহায্য মাটির নিচ থেকে এ কয়লা উত্তোলন করা হয়। উত্তালনকারীরা নৌকা নিয়ে এ সব কয়লা বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। মাঝারি সাইজের এক নৌকা পরিমান পিট কয়লা তারা ৩০০ টাকা থেকে ৪০০টাকায় বিক্রি করে থাকে। চান্দার বিল এলাকায় রান্নার কাজে জ্বালানী হিসাবে পিট কয়লা ব্যবহার করা হয়। বিল চান্দা গ্রামের বেশ কয়েক জন গৃহবধুকে পিট কয়লা দিয়ে রান্না করতে দেখা গেছে। এই পিট কয়লার রান্না খাবারে কিছুটা গন্ধ অনুভূতি হয় বলেও তারা জানান। পিট কয়লায় রান্না খাবার খেলে গ্যাষ্ট্রিকসহ নানা রকম রোগ ব্যাধি হয় বলে ও এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। যে কারনে অনেক গৃহবধূ জ্বালানী সংকট সত্বেও কয়লায় রান্না বান্না করেন না।
অতিথি পাখির আগমন চান্দার বিলে এখনো অতিথি পাখি আসে। কিন্তু আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে না। বিল এলাকার গ্রাম কৃষ্ণ নগরের ৭০ বছরের বৃদ্ধ শ্রীধাম কীর্তনিয়া জানায়, স্বাধীনতার আগে শীত কালে যে ভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার পাখি চান্দার বিলে দেখা যেত তা আর এখন দেখা যায় না। কয়েক বছর আগেও শীতকালে বেশ কিছু অতিথি পাখির আগমন ঘটতো। শিকারীদের উৎপাতে অতিথি পাখির আগমন দারুন ভাবে হ্রাস পেয়েছে। শীতকালে হাতে গোনা কিছু অতিথি পাখি আসলেও স্থানীয় শিকারীরা ফাঁদ ও কৌশলে বিষ প্রয়োগ করে সেগুলিকে হত্যা করে। শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায় না দেশী পাখিরাও। সারা বছরই দেশীয় পাখিদের মৃত্যু ঘটে শিকারীদের হাতে। তারপরও চান্দার বিলে পাখি আসে পাখি যায়।
পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী কৃষক গৌর চন্দ্র বৈরাগী বলেন, আগের মতো বিপুল পরিমান পাখি এখন আসে না বটে কিন্তু শীতকালে কিছু অতিথি পাখি এবং সারা বছর নানা প্রজাতির দেশী পাখি চান্দার বিলে দেখা যায়। শিকার বন্ধ করা করা সম্ভব হলেই চান্দার বিলে পাখি বিচরন বাড়বে বলে সচেতন এই কৃষক তার অভিমত ব্যক্ত করেন। দেশে অতিথি পাখিসহ দেশী পাখি শিকার নিষিদ্ধ রয়েছে এ ব্যাপারে জানা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, শুনেছি এ সংক্রান্ত আইন রয়েছে কিন্তু এ বিশাল বিলে কোন দিন এর প্রয়োগ দেখিনি।
প্রশাসনের উদাসীনতা এবং স্থানীয় জনসাধারনের অসচেতনতার কারনে পরিবেশ বিরোধী কর্মকান্ডে চান্দার বিলের হাজার হাজার জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে দাড়িয়েছে। সম্প্রতি এ প্রতিবেদক চান্দার বিল এলাকার সরেজমিন পরিদর্শন করতে গিয়ে এই জলাভূমির বর্তমান করুন হাল দেখতে পান। যদিও চান্দার বিলের চিরন্তন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হুমকির মুখোমুখি হয়ে তার ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তথাপি বাংলাদেশ সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড ষ্টাডিজ (বিসিএএস) এর তৎপরতা কিঞ্চিৎ আলোর পথ দেখাচ্ছে। সংস্থা চান্দার বিলের পরিবেশের উপর নাটক, সেমিনার, আলোচনা সভা, র্যালীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারনকে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও সময়ই বলে দেবে তারা কত টুকু সফলতা অর্জন করেছে। টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচীর অধীনে আইডউসিএন-এর প্রকল্প হিসাবে মধুমতির প্লাবন এলাকায় জীব বৈচিত্রের উপর বিসিএএস কাজ করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানটি চান্দার বিল এলাকার জনগনকে বিভিন্ন মুখী প্রকল্পের মাধ্যমে সচেতন করে এই জলাভূমির জীব বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছে প্রাকৃতিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অভয়ারন্য গড়ে তোলার অভিমত দিয়েছেন সচেতন মহল।