তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কালি মন্দিরে শহিদুল বাহিনীর হামলায় প্রতিমা ভাংচুর
রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নাম তার শহিদুল ইসলাম। নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের মেড়িয়া গ্রামের মৃত-লোকমান প্রামাণিকের ছেলে। যিনি সুদের ব্যবসা করে রাতারাতি হয়ে যান টাকাওয়ালা। যিনি সুদের টাকা আদায় করার জন্য করতেন সুদের হালখাতা। এক সময়ের বিএনপি নেতা অক্ষরজ্ঞানহীন শহিদুল হঠাৎ করেই হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা।
নিজ এলাকা এবং আশেপাশের এলাকার মাস্তানদের নিয়ে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। স্থানীয় প্রবীণ ও বর্তমান ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতাদের পেছনে ফেলে দখল করে নেন মিরাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদটি। একই সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদটিও দখল করে নেন সুদারো শহিদুল। আর এরপর থেকে শুরু হয় তার দখলবাজ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। তার সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জবর-দখল শুরু করেন একের পর এক খাস জমি, খাল ও বিল। এলাকার অসহায় মানুষরা জিম্মি হয়ে পড়েছে তার হাতে। কোন ব্যক্তি তার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেই তাকে করা হয় নানা ভাবে হয়রানী ও প্রদান করা হয় নানা রকমের ভয়-ভীতি। শহিদুলের এই সব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে এলাকার অনেক ত্যাগী নেতারা মাঠ ছেড়েছেন। শহিদুলের একক সন্ত্রাসী রাজত্বের কাছে আজ স্থানীয় নেতাসহ সাধারণ মানুষরা অসহায়। এই শহিদুলের কারণে স্থানীয় নেতাদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন সবাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, হঠাৎ আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়া সুদারো শহিদুলের অত্যাচারে আজ আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। তার সন্ত্রাসী আর দখলবাজী কর্মকান্ডে আমরা অতিষ্ঠ। আমরা যেখানেই যাই সেখানেই শহিদুলের হানা। সে বিল এলাকা অধ্যুষিত মিরাটের সব উন্মুক্ত খাল-বিল ও দহ জবর-দখল করেছে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে। যে সব উন্মুক্ত খাল-বিল ও দহ থেকে এলাকার শত শত গরীব মৎস্যজীবীরা মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসতো। মির্থ্যে বাহানায় একের পর এক খাস জমি ও উন্মুক্ত খাল-বিল ও দহ জবর-দখল করে ভোগ করছে এই শহিদুল। তারই নেতৃত্বে অবৈধভাবে নিষিদ্ধ সুতি জাল দিয়ে নিধন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় সব মাছ। অবৈধভাবে খালে কাঠা দিয়ে দখল করেছে এই শহিদুল। এরকম হাজারো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ পাওয়া গেছে এই সুদারো শহিদুলের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভয় ও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কেউ মুখ খুলতে চান না।
সম্প্রতি ফেইসবুকের লেখাকে কেন্দ্র করে রংপুরে সংখ্যালঘুদের উপড় সন্ত্রাসী হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার (১৭নভেম্বর) দিনগত গভীর রাতে শহিদুলের সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পার্শ্ববর্তি আত্রাই উপজেলার (শহিদুলের বাড়ির পাশে) বড়-কালিকাপুর (ভাটোপাড়া) গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কালিমন্দিরে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কালি প্রতিমাসহ সমুদয় প্রতিমা ভাংচুর করে। শহিদুল বাহিনী মন্দিরে প্রবেশ করে কালি প্রতিমাসহ মহাদেব, ডাকিনী-যোগিনীসহ ৫টি প্রতিমার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাংচুর করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বড়-কালিকাপুর গ্রামের আশেপাশের মাঠের ধান ক্ষেতে পানি সেচের জন্য একাধিক (গভীর নলকূপ) প্রকল্প রয়েছে শহিদুলের। শহিদুল তার সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের কাছে থেকে পানি সেচের জন্য দীর্ঘদিন যাবত অতিরিক্ত টাকা আদায় করে আসছিলো। সম্প্রতি সেই কৃষকরা শহিদুলের প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এসে অন্য প্রকল্পে কম মূল্যে পানি নিতে সম্মত হলে শহিদুল এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শহিদুল এই বিষয় নিয়ে ওই গ্রামে একাধিকবার বৈঠক করেও সমাধান করতে ব্যর্থ হন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে শহিদুলের সঙ্গে ওই গ্রামের কিছু মানুষের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তুচ্ছ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহিদুল ওই এলাকায় তার আধিপত্য স্থায়ী করার জন্য গত শুক্রবার গভীর রাতে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ওই গ্রামের সংখ্যালঘু মানুষদের ওপড় হামলা, মারপিট এবং সংখ্যালঘুদের ৫টি প্রতিমা ভাংচুর করেন। এলাকাবাসীরা এই জঘন্য কাজ করার জন্য শহিদুলের দৃষ্টান্তর মুলক শাস্তি দাবী জানান।
এমন ঘটনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় রাণীনগর ও আত্রাই থানা পুলিশ এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শহিদুল ইসলাম প্রামানিক (৪৬) সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলো বড়-কালিকাপুর গ্রামের মৃত-আলেম উদ্দিনের ছেলে মো: স্বপন (৩৭), একই গ্রামের আবু জাহিদ খন্দকারের ছেলে মো: রতন খন্দকার (৩৩), রাণীনগরের মেড়িয়া গ্রামের মৃত-নাজমুল হুদার ছেলে মো: পলাশ খান (২৫), একই গ্রামের শহীদুল ইসলামের ছেলে মো: রনি ইসলাম (১৮) ও আফজাল প্রামানিকের ছেলে মো: কামাল প্রাং (৩২)। এরা সকলেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী নিরাঞ্জন প্রামানিক জানান, আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী এই কালি মন্দির। এখানে সকাল-সন্ধ্যা পূজা দেয়া হয়। গত শুক্রবার রাতে পূজা শেষে সকলে বাড়িতে চলে যায়। রাতের অন্ধকারে মন্দিরে প্রবেশ করে কালি প্রতিমাসহ তার সঙ্গে থাকা সকল দেবতার মাথা ভাংচুর করেছে তারা। শনিবার সকাল ৫টার দিকে স্থানীয়রা মন্দিরের প্রতিমাগুলো ভাঙ্গা অবস্থায় দেখতে পেয়ে থানায় খবর দেয়। খবর পেয়েই নওগাঁর পুলিশ সুপার মো: ইকবাল হোসেন ও আত্রাই থানার ওসিসহ পুলিশ ওই মন্দির পরিদর্শন করে ।
রাণীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মো: মফিজ উদ্দিন প্রাং ও আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৃপেন্দ্র নাথ দত্ত দুলাল উক্ত শহিদুলের বর্তমান রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করে বলেন, রাতের আঁধারে কে বা কারা প্রতিমা ভেঙ্গেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।
এ ব্যাপারে আত্রাই থানার অফিসার ইনচার্জ মো: মোবারক হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুরের খবর পেয়েই আমরা সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মন্দিরের কালি প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। পরে আমরা স্থানীয় মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করার পর প্রাথমিক ভাবে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ওসি আরো জানান, এঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।
নওগাঁর পুলিশ সুপার মো: ইকবাল হোসেন জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে উল্লেখিত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আটকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে কি না রহস্যজনক ভাবে পুলিশ প্রশাসন তা গোপন রেখেছেন।
উল্লেখ্য, উক্ত শহিদুল ইসলাম একসময় বিএনপির ক্যাডার ছিল। বিগত ২০০৪ সালে বাংলাভাইয়ের জেএমবির জঙ্গী তৎপরতার সময় সে ছিল সক্রিয় কর্মী। পরবর্তীতে ২০০৮ সাল নাগাদ সে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকে সে যেন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুরসহ বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাকে গ্রেফতারের পর তার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কিছু নেতা নামধারী দলবলসহ শহিদুলকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যাপক তদবিরের পাশাপাশি পুলিশের ওপর চাপও প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।