নির্যাতনে বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করেছে শারমিন আখতার মনি
নওগাঁ থেকে তোফাজ্জল হোসেন : নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রামগাঁ গ্রামের সাহার আলী ও নাদিরা বেগমের কন্যা শারমিন আখতার মনি। মনি বাল্য বিয়ের স্বীকার হয়েও শুধুমাত্র নিজের অদম্য আগ্রহও অধ্যাবসায়ের কারণে আজ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে যাচ্ছে। মনি জয়িতা বাংলাদেশের স্বীকৃতি না পেলেও সমস্ত যোগ্যতায় তার রয়েছে।
শারমিন আখতার মনি ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের পরে বাল্য বিয়ের স্বীকার হন। তার বাবা মা ইচ্ছের বিরুদ্ধে একই উপজেলার শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া গ্রামের মাসুদ ইকবালের সাথে বিয়ে দেন। মনি বিয়ের পীড়িতে বসলেও পড়া লেখা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পোষন করেন। কিন্তু স্বামী বা স্বামীর বাড়ীর কেউই তাকে পড়ালেখা করতে বাধা প্রদান করে। শত বাধা অতিক্রম করে গোপনে সে পালিয়ে এসে ২০০৯ সালে নিয়ামতপুর উপপজলা সদরে এসএসসি পরীক্ষা দেন। বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। সে এসএসসিতে জিপিএ-৩.৭৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর আবারও পড়ালেখায় বাধা। তারপরেও মনি স্বামীর পরিবারের বাধাকে অতিক্রম করে তানোর উপজেলার তালন্দ আনন্দ মোহন ডিগ্রী কলেজে একাদ্বশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। শুধু মাত্র লেখাপড়া করা ও স্বাবলম্বী হাওয়ার আকাংখা থাকায় শারমিন আখতার মনিকে তালাক দেন। তবুও মনি পড়ালেখা বন্ধ করেন নাই। ২০১১ সালে জিপিএ ৪.০০ পয়েন্ট নিয়ে এইচএসসিতে উত্তীর্ন হন। এবং একই কলেজ থেকে বিএসসিতে ৯৪৭ নম্বর নিয়ে হায়ার ফাষ্টক্লাস নিয়ে উত্তীর্ণ হন। শুরু করেন উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য। রাজশাহী কলেজ থেকে প্রাণি বিদ্যায় প্রিভিয়াস করে মাষ্টর্স এ লেখাপড়া করছেন। আগামী ডিসেম্বর মাসে মাষ্টার্স এর ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে তিনি বিএড শেষ করেছেন। বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে এক বছরের কোর্স সম্পূর্ন করছেন। এটিও আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে।
শারমিন আখতার মনি তার বিভীষিকাময় জীবনের কাহিনী বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। তিনি কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন, আমরা দু বোন এক ভাই। আমি সবার বড়। একমাত্র ভাই প্রতিবন্ধি। ছোট বোন আগামী বছর এইএসসি পরীক্ষা দিবে। ছোট ও গরীব পরিবার বলে আমার বাবা মা আমি যখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি পরীক্ষার ফরম পূরণ হয়ে গেছে সেই সময় আকর্ষিক আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার বিয়ে হলেও আমার ইচ্ছ আমি পড়ালেখা করবো। বার বার আমার স্বামীকে বলেও সে কোনভাবেই আমাকে পড়ালেখার অনুমিত দেননি। আমি নিরূপায় হয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে গোপনে স্বামীর বাড়ী থেকে পালিয়ে এসে এসএসসি পরীক্ষা দেই। এ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অনেক বিচার সালিশ করেছে। কিন্তু তবুও আমার একই জেদ আমি লেখাপড়া করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো, স্বাবলম্বী হবো। শুরু হয় আমার উপর শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। তবুও আমি আমার ইচ্ছেই অনড়। অবশেষে স্বামী আমাকে তালাক দেয়। তাতেও আমি ভেংগে পড়িনি। নতুন করে জীবন শুরু করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। একই ভাবে এইচএসসি, ডিগ্রী, মাষ্টার্স, বিএড সম্পূর্ন করি। বর্তমানে আমি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে এক বছরের প্রশিক্ষন নিচ্ছি ও মাষ্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
শারমিন আখতার মনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমি সরকারের সহযোগিতা পেলে অবশ্যই স্বাবলম্বী হবো। নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে পারবো। আমি দেশের ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না, আমি দেশের ও সমাজের সম্পদ হতে চাই। আর তাই আমি সরকার ও সমাজের সচেতন মহলের সহযোগিতা কামনা করি। পাশাপাশি আমার মত নারীদের বলতে চাই আপনারা কোন অবস্থাতেই নিজেকে অসহায় মনে করবেন না। লেখাপড়া করে নিজেকে তৈরী করুন। স্বাবলম্বী হন।