পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ :প্রধানমন্ত্রী
রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে পাবনার ঈশ্বরদীর পদ্মাতীরের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লির জন্য কংক্রিটের মূল স্থাপনা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে— জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করলো।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান দেবে। এর মাধ্যমে অল্প খরচে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ৫ স্তরের নিরাপত্তা বিশিষ্ট ভিভিইআর প্রযুক্তি থাকবে। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় দুটি চুল্লিতে থাকবে তিন স্তরের নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা সংস্থাকেও বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
১৯৬১ সালে পদ্মা নদীর তীরে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা প্রকল্পের চেহারা নিতে অর্ধশতক পার হয়ে যায়। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়ার সফরের সময় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য দেশটির কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার একটি চুক্তি হয়।
ওই বছরের অক্টোবরে রূপপুরে এর ভিত্তি স্থাপন হয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আণবিক শক্তি করপোরেশন-রসাটমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এএসই গ্রুপ অব কোম্পানিজ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রূপপুরের ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করছে সরকার। আর পরের বছর চালু হবে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ জেলাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। নতুন করে সাজানো হয়েছে প্রকল্পের আশপাশের এলাকা।
ঈশ্বরদীর দাশুরিয়া মোড় থেকে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প পর্যন্ত সড়ক তোরণ আর বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে। তৈরি করা হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়।
কর্মরত প্রধান প্রকৌশলী ইউরিক মিখাউল খোসলেভ বলেন, ২০১৭ সালটি রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বছর রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাববেইজ তৈরি করা হয়। আর এ বছরই শুরু হচ্ছে রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরির কাজ। এখন থেকে ৬৮ মাসের মধ্যে বিদুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।
অবকাঠামো ছাড়াও চলছে অনেক কাজ। ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার ইত্যাদি—এ সব কথা উল্লেখ করে মিখাউল বলেন, প্রতিদিন রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি কর্মী মিলে এক হাজারের বেশি লোক দিন-রাত কাজ করছে।
প্রকল্পের প্রযুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে থ্রি-প্লাস রিঅ্যাক্টর ব্যবহৃত হবে— এটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তি, যা শুধু রাশিয়ার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে রয়েছে। রূপপুরেই হবে এর দ্বিতীয় ব্যবহার।
আগামী ২০২০ সালের মধ্যেই রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ সব যন্ত্রপাতিই রাশিয়া থেকে চলে আসবে— তারপর এখানে অ্যাসেম্বল করা হবে বলে তিনি জানান।
নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, রূপপুর প্রকল্পে আট মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় রিঅ্যাক্টর ঘিরে রয়েছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়। রাশিয়ান ফেডারেশন নির্মিত অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এর পরও যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেও, এর তেজস্ক্রিয়তা জনগণের নাগালের মধ্যে যাবে না। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রের বর্জ্য নিয়ে যাবে রাশিয়া। কাজেই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্তই বলা যায়।
প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে। আর এর থিকনেস হবে তিন মিটার।
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা ১১টি ও ১৬তলা আটটি ভবনের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ অন্যান্য স্থাপনা।
কর্মরত প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, মূল স্থাপনার আগে মাটি স্থিতিশীল করার জন্য যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চার হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ১৩ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটারের কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। আসছে জানুয়ারির মধ্যেই পুরোটা শেষ হবে। বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম বলে এ কাজ করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার আগে রূপপুরে পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে চুক্তি হয় রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের।
চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণব্যয়ের ৯০ শতাংশই ঋণ হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া।
রূপপুরে ১২০০ করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে; যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।
৫০ বছর আয়ুর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের মধ্যে চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরে আরও ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এছাড়াও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিন সিটি আবাসন পল্লী প্রস্তুতের কাজও চলছে পুরোদমে। পাবনা গণপূর্ত অধিতদপ্তর এটা বাস্তবায়ন করছে।
এরই মধ্যে তিনটি সুউচ্চ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা ও ১৬ তলাবিশিষ্ট ২২টি সুউচ্চ ভবন তৈরি হবে। এ ছাড়া থাকবে বহুমুখী ব্যবহারের জন্য হল, মসজিদ, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বেশ কয়েকটি স্থাপনা তৈরিও হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী মালপত্র নদীপথে আনা হবে। এ জন্য সরকার একটি নদী খনন প্রকল্প অনুমোদন করেছে। মোংলা থেকে চাঁদপুর, মাওয়া, গোয়ালন্দ হয়ে পাকশী পর্যন্ত নৌপথ খননে ৯৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ।
রেলপথেও যন্ত্রপাতি আনা হবে। এ জন্য ঈশ্বরদী থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রস্থল পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হবে। এর মধ্যে ব্রডগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে ১৭ দশমিক ৫২ কিলোমিটার। এ ছাড়া সাড়ে চার কিলোমিটার লুপ লাইন, একটি 'বি' শ্রেণি রেলওয়ে স্টেশন, সাতটি কালভার্ট, ১৩টি লেভেল ক্রসিং গেট ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা নির্মিত হবে। এ জন্য মোট ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে নিতে একটি সাবস্টেশনসহ সঞ্চালন লাইন স্থাপনে ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। ভারতীয় ঋণে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২১ সাল।
জনবল প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের ৮৮ কর্মকর্তাকে ভারতে ফাউন্ডেশন কোর্স অন নিউক্লিয়ার এনার্জি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
এসব কর্মকর্তারা বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় কাজ করছেন। এই কেন্দ্র পরিচালনার জন্য পর্যায়ক্রমে দুই হাজার ৭০০ জনবল (২০১৭-২০২২) নিয়োগ দেয়া হবে। এরই মধ্যে ১২০ জন কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে রোসাটমের সহায়তায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা নিউক্লিয়ারের ওপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া জনবল প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ সহযোগিতা নিতে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে।