টাঙ্গাইলে হানাদার মুক্ত দিবসের আমন্ত্রণ কার্ডে নাম নেই কাদের সিদ্দিকীর
অন্তু দাস হৃদয়, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি :
টাঙ্গাইলে ১১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাঁক জমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিজয় দিবসের ছয়দিন ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কাদেরিয়া বাহিনী এই অনুষ্ঠান উদযাপন করে আসছিল। কিন্তু পরে টাঙ্গাইল পৌরসভার আয়োজনে হানাদারমুক্ত দিবস ও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে।
এইবারও ব্যাপক ঘটা করে এ অনুষ্ঠান পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমন্ত্রণ কার্ডও ছাপানো হয়েছে, তবে গত বছরের মত এবারো সেই আমন্ত্রণ কার্ডে নাম নেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন কারী জননেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম’র।
১৯৯০ সালে টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস প্রথম পালন করে সপ্তসুর সাংস্কৃতিক সংস্থা। পরে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে দিবসটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হতে থাকে।
১১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করে তারা। এরপর পৌরসভার সাবেক মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি পৌরসভার উদ্যোগে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেন।
সেই দিবসে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরও অনেককেই নিমন্ত্রণ না করায় ২০১২ সালে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দেন কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে টাঙ্গাইলে আর হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হবে না।
এরপর, থেকে সেভাবেই টাঙ্গাইল পৌরসভার উদ্যোগে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। এর আগে শহীদ মিনারে সীমিত আকারে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও গত বছরের থেকে শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
৬ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী-এমপি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতশিল্পীসহ বরেণ্য ব্যক্তিদের নাম আমন্ত্রণ কার্ডে রয়েছে।
কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডারদের নাম থাকলেও নাম নেই মুক্তিযুদ্ধের টাঙ্গাইলের সংগঠক ও বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী জননেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর! এ নিয়ে শহরে মুখরোচক আলোচনাও হচ্ছে জোরেশোরে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আবু মোহাম্মাদ এনায়েত করিম, মরহুম অ্যাডভোকেট ছরোয় উদ্দিন, আলমগীর খান মেনুসহ ৭ জনকে নিজ হাতে অস্ত্র তুলে দেন।
যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী। নয় মাস প্রানপনে যুদ্ধ করে হানাদার মুক্ত করেন। অতীতে আমরা দেখেছি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যখন টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস পালন করতেন। তখন ১১ থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজন থাকত।
এ আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী অনেক দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি থাকতেন।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে আজ সেইদিন, যেদিন আমরা শত্র“মুক্ত হয়েছিলাম। সে উপলক্ষে ৬ দিন ব্যাপী আয়োজন থাকছে। মুক্তিযোদ্ধে টাঙ্গাইলের আরও সংগঠক জননেতা আব্দুল মান্নান, জননেতা শামছুর রহমান খান শাহ্জাহান, জননেতা মির্জা তোফাজ্জাল হোসেন মুকুল।
আজ ওনারা বেঁচে নেই। তবে যারা জীবিত আছেন অতিথিদের তালিকায় নাম নেই তাদের। নাম নেই জননেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর, নাম নেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর, নাম নেই মুক্তিযুদ্ধে চার খলিফা খ্যাত শাজাহান সিরাজের।
তিনি আরো বলেন, এখানে শুধু তারা নয়, এখানে মুক্তিযুদ্ধের আরেক খলিফা আ.স.ম আব্দুর রব, নূর এ আলম সিদ্দিকী, ১৯৬৯ এর মহানায়ক জাতির পিতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দানকারী তোফায়েল আহমেদ সহ মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী রথী, মহারথীদের অতিথি করা উচিত ছিল। কিন্তু বেনামী মুক্তিযোদ্ধাদের অতিথি করা হচ্ছে।
যাদের জন্য আমরা পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ, পেলাম স্বাধীন টাঙ্গাইল তাদের রেখে কি করে হচ্ছে এসব আয়োজন? এসব আয়োজনের শুরু করেছিল সাবেক মেয়র মুক্তি। আজ তো সে নেই। আর মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে এমনেও কোন দ্বিমত নেই তাদের সাথে। তবে কেন এহেনু আচরণ? কেন এর অনুসরণ?
অধ্যাপক ফাহমিদা নীলা বলেন, হানাদার মুক্ত দিবসে যে মানুষটি নেতৃত্ব দিয়েছিল, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই মানুষটির নাম ৬ দিন ব্যাপী প্রোগ্রামের কোথাও নাই। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জন্ম না নিলে টাঙ্গাইলের তথা দেশের মুক্তি যুদ্ধের কথা চিন্তাই করা যায় না। তাকে বাদ দিয়ে টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস কিভাবে পালিত হয় আমার বোধ গম্য নয়। শুধু বঙ্গবীর নন, খ. আব্দুল বাতেন কে এরা কিভাবে ভুলে গেলেন ?
টাঙ্গাইলের মুক্তি যুদ্ধের ২ টি বাহিনী- কাদের বাহিনী ও বাতেন বাহিনী। যাদের নাম ৮ম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে অংকিত।
তবে কেন তাদের আনডারে যারা যুদ্ধ করেছে তাদেরকে নিয়ে হানাদার মুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে? তাদের সাথে নিয়ে কেন নয়? না যে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি ইতিহাস দিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কেন এই প্রহসণ?
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ১১ ডিসেম্বর বাংলার দামাল ছেলেরা পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। এদিন উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী দেশের সীমানা পেড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
কাদেরিয়া বাহিনী সখীপুরের বহেড়াতৈলে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন।
এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সহ আরো ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণ-পরিষদ সদস্য শামছুর রহমান খান শাজাহান, আব্দুর রাজ্জাক ভোলা ছিলেন অগ্রগণ্য। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হবার পর চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষণ। পাকিন্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর দখল করে।
টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুরো বাহিনী টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখীপুরের বহেড়াতলীতে চলে যান। সেখানে শুরু হয় এ বাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় ‘কাদেরিয়া বাহিনী’। এ বাহিনীর সদস্য ১৭ হাজারে উন্নীত হয় ।
এ ছাড়া ১৮ হাজার সেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা এবং সাত হাজার রাজাকার আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান করে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের।
এ সব যুদ্ধে ৩ শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হয় টাঙ্গাইল আক্রমণের। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ হয় পাক সেনাদের পুংলি নামক স্থানে।
অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ ভয়ে পাক সেনারা টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী চারদিক থেকে সাড়াশী আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী।
১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়োজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছান।
আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। ১১ ডিসেম্বর ভোরে কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে দখলে নেন এবং শহরকে শত্র“মুক্ত করেন। এরপর তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেন।