অনেকটা আড়ালে আবডালেই বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পখাত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।
অনেকটা আড়ালে আবডালেই বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পখাত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন ঔষধের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ঔষধ উৎপাদন, বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ঔষধ বিদেশে রপ্তানি-সবখানেই এই খাতের সাফল্য এখন আকাশ ছোঁয়া। প্রতি বছরই ঔষধ শিল্পখাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন আর বিস্ময়কর সব সাফল্য আসছে। ঔষধ রপ্তানির দেশের সংখ্যাও একের পর এক বেড়ে চলেছে। ঔষধ আমদানিও কমে আসছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে এই খাতের মেধাবী উদ্যেক্তা, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের নিরলস পরিশ্রম এবং সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ধারাবাহিক সহযোগিতার কারণে। একসময় কারো কল্পনাতেও ছিল না যে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষুধ কিনে খাবে। অথচ সত্যটা হলো-বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধ এখন আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। সেদেশের মানুষ আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধ ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি এ খাতের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো-গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে আমেরিকাসহ বিদেশের বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করা। বিদেশের বাজারে প্রতিনিয়ত আমাদের উৎপাদিত ঔষধ রপ্তানি হচ্ছে, যার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গর্বের সাথেই উল্লেখ করতে হয় আগে অনেক ঔষুধ বাজারে পাওয়া যেত না, বাইরের দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো, কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। আমাদের দেশে এখন অনেক উন্নত মানের ও উচ্চ প্রযুক্তির ঔষধ তৈরি হচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়, সময়ের সাথে সাথে এই খাতে বহুবিধ পরিবর্তন ও নতুনত্বও আসছে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো এখন শুধু ঔষুধ উৎপাদনেই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেনি, আন্তর্জাতিক বাজারকে সামনে রেখে নিজেদেরকে বিভিন্নভাবে বিস্তৃত করছে। বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট তৈরি করা থেকে শুরু করে ঔষধের কাাঁচামাল তৈরিতেও মনযোগী হয়েছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো।
২০১৬ সালে বিদেশ থেকে আমদানির চাপ ও ঝুঁকি কমিয়ে আনতে দেশেই বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট তৈরি শুরু করে দেশের অন্যতম ঔষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। তাদের এই উদ্যোগে সারথী হয় বায়োইঞ্জিনিয়ারিং (সুইজারল্যান্ড) এবং এএমএস টেকনোলোজি (জার্মানি)। মনে আছে সে বছরের (২০১৬ সাল) ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে ঢাকা ওয়াটার গার্ডেনে ‘সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্ট’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মি. ক্রিসচিয়ান ফোচ্। আরও উপস্থিত ছিলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ‘সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্ট’-এর অন্যতম পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির, ‘সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্ট’-এর পরিচালক গ্যাবরিয়ালা মায়ার, ‘সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলেকজান্ডার ডলডার।
সেদিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের মাননীয় রাষ্ট্রদূত মি. ক্রিসচিয়ান ফোচ্ বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিকাশমান ঔষধ শিল্পের আরও অগ্রগতিতে ‘সুইস বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট’ বড় ধরনের প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আগামীতে আরও সমৃদ্ধ করবে।ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ‘সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্ট’-এর অন্যতম পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসেই ঔষুধসহ খাদ্য ও বেভারেজ শিল্পের একজন উদ্যোক্তা এখন বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট এবং এএমএস টেকনোলজি (অ্যাপারেট মেশিন সিস্টেম টেকনোলজি) চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবেন। বিদেশ থেকে এ ধরনের ইকুইপমেন্ট এখন আর আমদানী করতে হবে না।
সন্দেহ নেই “সুইস বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট” আন্তর্জাতিক মানের সেবা এবং টেকসই পণ্য সরবরাহের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্পকে সমৃদ্ধির পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটা সত্য যে আব্দুল মুক্তাদিরের মতো দেশপ্রেমিক স্বপ্নবান আত্মবিশ্বাসী প্রচারবিমুখ আধুনিক উদ্যোক্তাদের কারণেই আজ ঔষধ শিল্পের এক বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে।
ঔষধ শিল্পখাতের এসব সাফল্য ও গল্প আমাদের অর্থনীতিকে মজবুত করছে। একসময় জীবনরক্ষাকারী যেসব ভ্যাকসিনের জন্য মানুষকে মাথা কুটতে হতো, এখন সেই সব ভ্যাকসিন উৎপাদন করে দারুণ সক্ষমতা দেখিয়েছে ইনসেপ্টাসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানটি। এইতো কদিন আগে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ঔষুধ শিল্প সমিতির আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৯ম এশিয়া ফার্মা এক্সপো। প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি। তিনি বললেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ৯৮ ভাগ মিটিয়ে বিশ্বের ১৫১টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের ঔষধ কোম্পানিগুলোর কত বড় সাফল্য তা বলে শেষ করবার নয়। আগামীতে ঔষধ শিল্পখাত আরো এগিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে ছাড়বে।
ঔষধ শিল্পখাতের পেছনের ইতিহাস খুবই করুণ বললে ভুল হবে না। তথ্য বলছে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০ ভাগ ঔষধ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হতো। ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি দেশের এই খাতকে কুক্ষিগত করে ফেলেছিল। কিন্তু আশির দশকে এই খাতের এক নবযাত্রা শুরু হয়। নতুন নতুন ঔষধ কোম্পানি খুলতে এগিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশে প্রতি বছর ঔষুধের বাজারের পরিধি ১৭ হাজার কোটি টাকার উপরে। আর এখন পর্যন্ত প্রতিবছর রপ্তাানি হচ্ছে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বিভিন্ন ধরনের ঔষধ।
ঔষুধ শিল্পখাতের সার্বিক বিকাশ এবং অগ্রযাত্রায় অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বেশ আগেই ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে। এতে ঔষধের মান বৃদ্ধির সুযোগ আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে ঔষধের পরীক্ষা ও বিশ্লেষন ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ডিজিটাইজড করায় তথ্য আদান-প্রদানের অপার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণ যাতে করে সব ধরনের তথ্য পেতে পারে সেজন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটকে অ্যাকটিভ রাখা হয়েছে এবং সেখানে সব ধরনের তথ্য সন্নিবেশ করা রয়েছে।
ঔষধ শিল্পকে সামগ্রিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলায় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস বা এপিআই শিল্পপার্ক স্থাপন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির নামে প্লট বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এই পার্ক পরিপূর্ণভাবে চালু হলে ঔষধ শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ঔষুধের কাঁচামালের জন্যে আর বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। উল্টো এই পার্ক পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে দেশি কোম্পানিগুলো কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের জন্যে আয় বাড়াতে পারবে।
এই খাতের আরেকটি বড় সাফল্য হলো-ইতিমধ্যেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগাইনাইজেশন(ডব্লিউটিও) আগামী ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঔষধ শিল্পে মেধাস্বত্তে ছাড় দিয়েছে। যার ফলে আগামীতে আমাদের ঔষধ রপ্তানির সুযোগ আরও অবারিত হয়েছে। ফলে দামি ঔষধগুলো আমাদের দেশেই তৈরি হবে।
বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প খাত মূলত বেসরকারি পর্যায়ে একটি দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প খাত, যা দেশের জাতীয় উৎপাদন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এ খাত থেকে প্রতিবছর আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি, যা আমাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এছাড়া এ খাত প্রতিনিয়ত দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছে। যা দেশের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য মোচনেও প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
এটিতো সত্য যে ঔষধ আর দশটা ভোগ্যপণ্যের মতো নয়। যেনতেন করে বা ইচ্ছেমতো উৎপাদন করা যায়। ঔষধ উৎপাদন করতে সবসময় ডাব্লিউ এইচও’র গাইড লাইন এবং অপরাপর নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। সেই নির্দেশনার বরখেলাপ হলে কোথাও ঔষধ গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশে ঔষধ রপ্তানির ক্ষেত্রে সে দেশের নিয়মনীতি সুনির্দিষ্টভাবে পূরণ করতেই হবে।
বিশেষ করে সেসব দেশের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থাসমূহের শর্ত সঠিকভাবে পালন করা না হলে সেদেশের বাজারে ঔষধ রপ্তানি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। ঔষধ শিল্প খাত বিশ্ব বাজারে আরো সফলতা অর্জন করুক, এই খাত থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হোক- আমরা এই প্রত্যাশা করছি।