গোপালগঞ্জে ক্রমাগত বাড়ছে সিজারিয়ান অপারেশন
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি 4TV
গোপালগঞ্জে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ঘটনা ক্রমাগত ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল গুলোতে এর একটা পরিসংখ্যান থাকলেও বাইরের ক্লিনিক গুলোর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়না কখনোই। এ সব বন্ধ হওয়া দরকার এমন মন্তব্য করে চিকিৎসকরা দোষ দিচ্ছেন কিছু স্বার্থলোভী ক্লিনিক ও ডাক্তারদেরকে। এমনকি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য বিভাগীয় সংসদীয় কমিটির সভাপতিও সিজারিয়ান অপারেশন কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন।
গোপালগঞ্জ জেলা সদরসহ অন্যান্য উপজেলায় অন্তত অর্ধশত বৈধ কিংবা অবৈধ ক্লিনিক রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও অন্য চার উপজেলায় ৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ সব হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক গুলোতে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ঘটনা। সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল গুলোর পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও ক্লিনিক গুলোর হিসেবে রয়েছে প্রচুর গরমিল। এমনকি সিভিল সার্জন অফিসে প্রতি মাসে রিপোর্ট করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ স্বীকারও করে নিয়েছেন। ক্লিনিক গুলোতে সঠিক মনিটরিংও নেই। যে কারণে অপারেশনের দরকার না হলেও ক্লিনিক গুলোতে হরহামেশাই ব্যবসায়ীক কারণে সিজারিন সন্তান প্রসবের ঘটনা বেড়ে চলেছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ২০১৫ সালে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়েছে ২ হাজার ৪শ’ ২৬টি, সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে ৭শ’ ১৬টি। ২০১৬ সালে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়েছে ২ হাজার ২৮টি, সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে ৯শ’ ৭২টি। ২০১৭ সালে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়েছে ২ হাজার ২শ’ ৩৮টি এবং সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে ৭শ’ ৫৬টি।
হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আগত রোগীরা জানায়, ডাক্তারদের পরামর্শেই তারা সিজারিয়ান অপারেশন করিয়ে থাকেন। যখন ডাক্তাররা বলেন সমস্যা আছে তাই অপারেশন লাগবে। রোগী বা রোগীর স্বজনরা তখন আর দেরী না করে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের জন্য রাজী হয়ে যান।
বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার সরষপুর থেকে হাফিজুর সরদার তার মেয়ে মুক্তাকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে এনেছিলেন। নানা জটিলতার কারণে মেয়েকে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হয়েছে। ঠিক তেমনি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের আলমগীর শেখের স্ত্রীকেও সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে হয়েছে। এটি তার দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তানটি সিজার করে হয়েছে তাই দ্বিতীয়টিতেও সিজার করতে হয়েছে বলে তিনি জানান।
সদর উপজেলার পাটকেলবাড়ি গ্রামের ঝর্ণা হালদারের প্রথম সন্তান স্বাভাবিক ভাবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু সমস্যার কারণে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে সিজার করে। এমন হাজারো প্রমাণ মিলবে। কেউ যেন কোন দ্বায়িত্ব নিতে চায়না। কিন্তু এতে করে স্বাভাবিক জন্ম প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে।
গোপালগঞ্জ শেখ সাহেরা খাতুন মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ অসিত কুমার মল্লিক, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের গাইনি কনসালটেন্ট ডা: ফারিয়া জামান, বিএমএ গোপালগঞ্জ শাখার সভাপতি ডা: আবিদ হাসান, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা: ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী ও গোপালগঞ্জে সিভিল সার্জন ডা: মো: রবিউল হাসানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হলে তারা জানান, হাসপাতালগুলোতে একান্ত প্রয়োজন না হলে কখনোই সিজার করে বাচ্চা প্রসব করানো হয় না। তবে ক্লিনিক গুলোর চিত্র ভিন্ন বলে তারা মন্তব্য করেন। তারা জানান, সেখানে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের ঘটনা কম। ক্লিনিকের মালিকদের অতিরিক্ত টাকার লোভ, আর সেই সঙ্গে কিছু কিছু ডাক্তারদেরকেও দুষলেন এসব চিকিৎসকরা।
তারা আরো জানান, অবশ্য কোন কোন রোগীর স্বজনরাও রোগীর কষ্ট লাঘবের জন্য এবং নিরাপদ মনে করে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করিয়ে থাকেন। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আশা দরকার বলে মনে করছেন চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ডাক্তাররা।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য বিভাগীয় সংসদীয় কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি সম্প্রতি গোপালগঞ্জে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দানকালে চিকিৎসকদের সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সিজার করে সন্তান প্রসব করিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য তিনি চিকিৎসকদের প্রতি আহবান জানান। সারাবিশ্বে যেখানে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবকে উৎসাহিত করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে সিজারিয়ান অপারেশনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে বেড়িয়ে আসতে সচেতনতা বাড়াতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।