চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র ,ক্রোয়েশিয়া দেশের অজানা কাহিনী
ক্রোয়েশিয়া। ১৯১৮ সাল থেকে এই রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়ার অঙ্গরাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত ছিল। নব্বই দশকের গোড়ায় এসে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রের বুকে ঠাঁই করে নেয়। এই শিশু দেশটির ফুটবল প্রেম আর ফিফার মঞ্চে উঠে আসার দৃশ্য আরও রোমাঞ্চকর। ফুটবলে দক্ষতা আর কৌশলী হওয়ার কারণে জন্মের মাত্র তিন বছর পর ১৯৯৪ তে ফিফা ‘বেস্ট মুভার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ ঘোষণা করা হয় ক্রোয়েশিয়াকে। আর ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে দেখিয়েছে ম্যাজিক। প্রথমবার বিশ্বকাপের দৌড়ে নেমেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল ক্রোয়েশিয়া। এতটুকু বললেই বোধ হয় ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ভৌগোলিক অবস্থান
ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত ক্রোয়েশিয়ার উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি ও স্লোভেনিয়া, পূর্বে সার্বিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে আদ্রিয়াটিক সাগর, বসনিয়া- হার্জেগোভিনা ও মন্টিনিগ্রো অবস্থিত। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত দেশটি। এটি ৪২ ডিগ্রি থেকে ৪৭ ডিগ্রি উত্তর ও ১৩ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে অবস্থিত। দেশটি দেখতে এক ফালি চাঁদের মতো। কেন্দ্রীয় মহাদেশীয় ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভোনিয়ায় সমভূমি, হ্রদ ও পাহাড় অবস্থিত। ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীও এই দেশে অবস্থিত যা দেশটির ভুখোভার শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। পশ্চিমে রয়েছে দিনারীয় আল্পস পর্বতমালার বৃক্ষ আচ্ছাদিত অংশ। আর রয়েছে আড্রিয়াটিক সাগরের পর্বতসঙ্কুল তটরেখা। এই উপকূলে আরও আছে হাজারের অধিক বিভিন্ন আকৃতির দ্বীপ। দেশটি ৫৬ হাজার ৫৯৪ বর্গকিলোমিটার (২১,৮৫১ বর্গমাইল) জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে ৫৬ হাজার ৪১৪ বর্গকিলোমিটার ভূমি (২১,৭৮২ বর্গমাইল) এবং ১২৮ বর্গকিলোমিটার জলভাগ (৪৯ বর্গমাইল) রয়েছে।
ইতিহাস
মাত্র ৪৫ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটি ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পায়। ১৯১৮ সালে দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মিলে গঠিত হয় যুগোস্লাভিয়া। ২৪ বছর পর নািস জার্মানি যুগোস্লাভিয়ায় হামলা চালায়। নিজেদের দখলও কায়েম করে। পরবর্তীতে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে যুগোস্লাভিয়া। মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে বিদেশি আগ্রাসনকারীদের প্রতিরোধ করে দেশবাসী। ১৯৪৩ সালে মার্শাল টিটো জাতীয় মুক্তি মোর্চা প্রতিষ্ঠা করে অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব নেন। এর মধ্যে যুগোস্লাভিয়ার জাতীয় বাহিনী সাত বার জার্মানির আক্রমণ প্রতিরোধ এবং ১৯৪৪ সালে দেশের প্রায় অধিকাংশ এলাকাই মুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে যুগোস্লাভিয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার স্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুগোস্লাভিয়ার যৌথবাহিনী সারা দেশকে মুক্ত করে। পরে নব্বইয়ের দশকে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, মেসিডোনিয়া, হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া নামে স্বাধীন হয়।
রাজনীতি
১৯৮০ সালে টিটোর মৃত্যুর পর থেকেই যুগোস্লাভিয়ায় রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক হানাহানি। সবাই জাতীয়তাবাদীর দিকে ঝুঁকতে থাকে। ১৯৯০ সালে প্রথম একাধিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচন হয়। ক্রোয়েশিয়ার মানুষ স্বাধীন আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে গৃহযুদ্ধে জড়ায়। জন্ম নেয় ক্রোয়েশিয়া। ওই সময়টায় পৃথিবীর রাজনীতির মানচিত্রটাও ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টুকরো হলো। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। অথচ কিছুদিন পরই ১৯৯১ সালের ২৫ জুন বিচ্ছিন্ন হয় ক্রোয়েশিয়া। দেশটির রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোতে পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী একটি বহুদলীয় ব্যবস্থায় সরকারের প্রধান। নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে এবং আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ক্রোয়েশীয় সংসদ বা সবার হাতে ন্যস্ত। বিচার ভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ হতে স্বাধীন।
ফুটবলের সোনালি ইতিহাস
ছোট্ট একটি দেশ। জনসংখ্যা মাত্র ৪৫ লাখ। ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছিল উরুগুয়ে। সেই তালিকায় নাম উঠে যেত ক্রোয়েশিয়ার কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। অসাধারণ নৈপুণ্যময় খেলা উপহার দেওয়া ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর। ১৯৯১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে ঠাঁই নেয়। ইউরোপের দেশ হওয়ায় ফুটবলের প্রতি তাদের ছিল ভিন্ন অনুভূতি। স্বাধীনতার পর ক্রোয়েশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন ফ্রাঞ্জো তুদজম্যান। তার শক্ত হাতেই নব্বই দশকে যুগোস্লাভিয়া তিক্ত ভাঙন ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফুটবলের প্রতি তার প্রেম বোঝা গিয়েছিল তার এক ভাষণে। তিনি বলেন, ‘ফুটবলে বিজয় একটি দেশের আত্মপরিচয়কে ততটাই রূপায়ণ করে, যতটা করে যুদ্ধ।’ তাই তো স্বাধীন হওয়ার পরই দেশটির প্রেসিডেন্ট দেশের ক্রীড়াবিদদের রাষ্ট্রদূত করার ঘোষণা দেন। স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুই বছর পর বিশ্ব ফুটবলের অংশ হয় ক্রোয়েটরা। সেই থেকে শুরু। গৃহযুদ্ধের কারণে ক্রোয়েশিয়ার উজ্জ্বল শুরুর সেই বর্ণচ্ছটায় কিছুটা ধীরগতি এসেছিল ঠিকই। কিন্তু পরের ২০ বছরে তাদের সেরা অর্জন ছিল ২০০৮ ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল। এর আগে জন্মের মাত্র তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে দুর্দান্ত অগ্রগতির জন্য ওই বছর ফিফার ‘বেস্ট মুভার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পায় ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৬ সালের সবচেয়ে বড় চমক ছিল নিজেদের প্রথম আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা। এর মাত্র দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে ক্রোয়েটরা প্রথমবার বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে অংশ নিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে। শুধু তাই নয়, সেই আসরে ক্রোয়েটদের অবস্থান হয় তৃতীয়। ওই বিশ্বকাপে টপ স্কোরার হয়ে বিশ্বের চোখ ওপরে তুলেছিলেন এক ক্রোয়েশিয়ান, নাম ডেভর সুকার। আর সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে রাশিয়ার মাটিতে ক্রোয়েশিয়ার বিপ্লবের অন্যতম মূল চাবিকাঠি হলেন ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের সোনার বুট জেতা ডেভর সুকার। নানা চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে ক্রোয়েশিয়া বর্তমানে ফুটবল বিশ্বে অন্যতম এক পরাশক্তি। শুধু তাই নয়, সারা বিশ্বে নিয়মিত ফুটবল প্রতিভা সরবরাহের পাইপলাইনও। স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড বা জার্মানি বিশ্বের বড় লিগের সবগুলোতেই ছোট ক্রোয়েটদের বড় দাপট। যার জ্বলন্ত উদাহরণ মডরিচ, রাকিটিচ, মানজুকিচ, পেরিসিচ ও লভরেনরা।
নয়নাভিরাম এক দেশ
ইউরোপ মহাদেশের এক নয়নাভিরাম দেশ। যার সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী ক্রোয়েশিয়া। এর রাজধানী জার্গেব। প্রাকৃতিক রূপে ক্রোয়েশিয়া এতটাই মোহনীয় যে, ২০১৭ সালে ১৮.৫ মিলিয়ন পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল দেশটিতে। দেশটির উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, পূর্বে সার্বিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে বসনিয়া, হার্জেগোভিনা ও মন্টিনিগ্রো। দেশটির উপকূলে প্রায় হাজারখানেকের মতো বিভিন্ন আকৃতির দ্বীপ রয়েছে। অপরূপ সুন্দর এই দ্ব্বীপগুলোয় প্রচুর পর্যটকের ভিড় হয়ে থাকে। ক্রোয়েশিয়া পর্যটকদের জন্য একদম উপযুক্ত একটি জায়গা আর সমুদ্র পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে এই বিশ্বে। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ক্রোয়েশিয়ায় ৮টি চমৎকার জাতীয় পার্ক রয়েছে। স্বচ্ছ পানির লেক আছে মন জুড়ানো। তার মধ্যে অন্যতম প্লিিভচ লেক। এটি ক্রোয়েশিয়ার বৃহত্তম লেক এবং ইউনেস্কো কর্তৃক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত। এ ছাড়া দেশটির মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ ঢাকা জঙ্গলে রয়েছে বহু অসাধারণ ঝরনা। এমন কিছু বনাঞ্চল আছে যেখানে এখন পর্যন্ত কোনো মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ ক্রোয়েশিয়া এবং অসাধারণ দৃশ্যের সমুদ্র দেখতে ক্রোয়েশিয়ায় আসতেই হবে পর্যটকদের।
এক নজরে ক্রোয়েশিয়া
♦ সাংবিধানিক নাম : প্রজাতন্ত্রী ক্রোয়েশিয়া
♦ মহাদেশ : ইউরোপ
♦ স্বাধীনতা লাভ : ১৯৯১ সাল
♦ আয়তন : ৫৬ হাজার ৫৯৪ বর্গ কি.মি
♦ রাজধানী : জার্গেব
♦ দাফতরিক ভাষা : ক্রোয়েশিয়া
♦ লৈখিক ভাষা : ল্যাটিন
♦ সরকার পদ্ধতি : সংসদীয় গণতন্ত্র
♦ জনসংখ্যা : ৪১ লাখ ৫৪ হাজার (২০১৭ সাল আনুমানিক)
♦ ধর্ম : রোমান ক্যাথলিক ৯১.০৬%, নাস্তিক ৪.৫৭%, মুসলিম ১.৪৭% ও অন্যান্য ২.৯০%
♦ মুদ্রা : কুনা
♦ মাথাপিছু আয় : ১৪ হাজার ৭৮৮ ডলার
♦ আয়ের উৎস : পর্যটন, পরিসেবা ও শিল্প-কলকারখানা
♦ চাকরিজীবী : প্রায় ৭০%
♦ আবহাওয়া : গ্রীষ্মপ্রধান
♦ বন : আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ
♦ প্রধান রপ্তানি পণ্য : মিনারেল ফুয়েল
আপনি কি জানেন?
— নয়নাভিরাম ক্রোয়েশিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে বনভূমি! পর্যটকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে অপরূপ সৌন্দর্যের দেশটির বন-জঙ্গল এবং ঝরনাগুলো। দেশটিতে এমন সব বনাঞ্চল আছে, যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি।
— বল স্পটের ডালমাশিয়ান কুকুর দেখেছেন? সাদা চামড়ার ওপরে কালো বলের স্পট। মনে হবে যেন পেইন্টিং করা। অপরূপ সুন্দর এসব কুকুর কেবল ক্রোয়েশিয়ায়ই দেখা যায়। এদের সাধারণত গির্জার ক্রনিকেলে দেখতে পাওয়া যায়। ডালমাশিয়ায় এর উৎপত্তি বলেই এর নাম ডালমাশিয়ান।
— গেম অব থ্রোন্সের কল্পরাজ্য ক্রোয়েশিয়া। ‘ওয়েস্টেরস’ নামের কাল্পনিক ওই দেশের রাজধানী ‘কিংস ল্যান্ডিং’-এর অস্তিত্ব যেন আছে ক্রোয়েশিয়ারই একটি শহর। নাম ডুব্রোভনিক। মূলত এখানেই গেম অব থ্রোন্স সিনেমার শুটিং করা হয়েছিল।
— পৃথিবীর অন্য কোথাও ‘টাই’ দিবস পালন হয় না। ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ক্রোয়েশিয়ায় ‘টাই-ক্রাভাত’ দিবস পালন করা হয়ে থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘থার্টি ইয়ার্স ওয়্যার’-এর সময় ফরাসি সেনাবাহিনীতে ক্রোয়েশিয়ানরা এই কাপড়টি পেঁচিয়ে রাখত।