অর্থ পাচার রোধে আইন আছে প্রয়োগ নেই
অর্থ পাচার রোধে দেশে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। আইনে পাচারকারীর দ্বিগুণ জরিমানা, ৪ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা গেছে, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকার সঞ্চয় রয়েছে। কিন্তু বৈধভাবে কাউকে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত অর্থ পাচারের তথ্য আসছে। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাচারকারীরা। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার এবং দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন। এরা এতটাই প্রভাবশালী যে কেউ তাদের কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। অন্যদিকে পাচার রোধে যে সব সংস্থা কাজ করছে, তাদের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সবমিলিয়ে অর্থ পাচার রোধ এবং আগে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনাতে তেমন আশার আলো নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এক্ষেত্রে চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, দেশে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই। অপরদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী কারণে এটি হচ্ছে, তা বোঝা দরকার। তিনি বলেন, এ টাকা পাচারের কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন তারা বিনিয়োগের পরিবেশ পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে না। অথবা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই। তারমতে, উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। তিনি এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এতে পাচার বাড়তে থাকবে। জানা গেছে, অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ ঠেকাতে সরকার এ সংক্রান্ত আইন আধুনিকায়ন করেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ নামে এটি পরিচিত। এই আইনের ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে তিনি অন্যূন ৪ (চার) বৎসর এবং অনধিক ১২ (বার) বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ আইনের ১৭(১) ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা মানি লন্ডারিং অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইলে আদালত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দেশে বা দেশের বাহিরে অবস্থিত যে কোনো সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।’ কিন্তু আইনটির কার্যকর প্রয়োগের অভাবে পাচার বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, টাকা পাচারের বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আইনের কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। প্রতি ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে গত বছরে ১০ থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যা দিয়ে ১৫টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। এর আগে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে ৮৪ জন বাংলাদেশির টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিএফআইইউ এবং দুদকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাচারের জন্য বড় ১০টি দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ৫ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, অর্থ পাচার রোধে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পাচার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এরপর দক্ষতা, সক্ষমতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, যারা অর্থ পাচার করছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এদের ক্ষমতা অনেক বেশি। সব সময় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরকারি সংস্থাগুলো এদের ধরতে সাহস পায় না। এদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে পাচারকারীদের র্বাতা দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে না। যখন ইস্যুটি সামনে আসে, তখন চুনোপুঁটি কাউকে ধরা হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা নিরাপদেই থাকেন। তার মতে, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইন-কানুনসহ কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। তিনি আরও বলেন, ২০০৭-০৮ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ওই সময়ে পারলে এখন পারা যাবে না কেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। দক্ষতা সম্পূর্ণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বিদেশ থেকে টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দুদকের বাইরে পুলিশ এবং ব্যাংক কাজ করে। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা লন্ডারিং করা হলে সেটি নিয়ে দুদক কাজ করে। ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদকের আওতা বেশি নয়। শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার হলেই শুধু তারা ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্প্রতি একজন সংসদ সদস্যের টাকা পাচারের তথ্য গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ীর ১ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৮ হাজার ৫শ কোটি টাকা। এছাড়া আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করার খবরও বেরিয়েছে। অথচ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বৈধভাবে কাউকে দেশের বাইরে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে ২২৭ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুদক। গত বছর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমের দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই জেলার আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ২০১৪-২০১৬ সালে ২৩৬ কোটি টাকা দুবাই ও সিঙ্গাপুরে পাচার করে এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামীম আহমেদ চৌধুরী। এছাড়া অর্থ পাচার করে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়া সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাড়ি করেছেন। প্রবাসীরা বলছেন, সেখানে বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ হাজারের মতো। এছাড়াও কুয়েতে লক্ষ্মীপুর ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের বিশাল পরিমাণ সম্পদ আটক করা হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের অন্যতম গন্তব্য কানাডা। গত বছর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন বিদেশে সম্পদ গড়ার দিক থেকে রাজনীতিবিদের চেয়ে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা বেশি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থের পুরোটা পাচার নয়। এখানে সুইজারল্যান্ডে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের বৈধ টাকা রয়েছে। এছাড়াও ব্যাংকিং সিস্টেমের বিভিন্ন অর্থ এখানে রয়েছে। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কাউকে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন চেষ্টা চলছে। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। তবে যেহেতু আমরা এগমন্টগ্রুপের সদস্য। তাই সেখান থেকে তথ্য পাওয়া যায়। সেভাবেই বিভিন্ন চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এছাড়াও রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিট্যান্স। একটি চক্র বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। ওইগুলোও পাচার হয়ে বিদেশের কোনো ব্যাংকে রাখা হচ্ছে।